গরুর মাংস নাকি মহিষের, কোনটা বেশি উপকারী
মহিষের মাংসে গরুর মাংসের চেয়ে ৪০% কোলেস্টেরল কম, ১১% আমিষ বেশি ও ১০% মিনারেল বেশি থাকে। এই মাংসে ভিটামিন বি-১২ এর পরিমাণ অনেক বেশি যা শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ও মানসিক বৃদ্ধি বিকাশের জন্য অপরিহার্য। মহিষের মাংসে গরুর তুলনায় কার্যকর আয়রন পরিমাণ বেশি থাকে।
মহিষের মাংসের দাম আমাদের দেশে তুলনামূলক গরুর মাংসের চেয়ে কম হওয়ায় ভোক্তাদের অনেকের মধ্যে মহিষের মাংস সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যদিও গুণে ও মানে গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি ও বেশ স্বাস্থ্যসম্মত।
হয়তো এ কারণে চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় মহিষের মাংস বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকে গরুর পরিবর্তে মহিষ দিয়ে কোরবানিও দিতে পছন্দ করে। গরুর তুলনায় মহিষের দৈহিক বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো, গরুর তুলনায় মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং এরা সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারে। মহিষের মাংস ও দুধে কোলেস্টেরলের মাত্রা গুরুর মাংস ও দুধ অপেক্ষা কম, তাই স্বাস্থ্যসম্মত।
মহিষ হলো পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি পশু। ভারতসহ ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দেশে উন্নত প্রযুক্তি, প্রজনন কৌশল ও ব্যবস্থাপনা মাধ্যমে মহিষের দুধ উৎপাদন অনেক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এটা আমাদের দেশেও সম্ভব।
অতিরিক্ত মুনাফার আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সারা দেশে ধোঁকা দিয়ে ভোক্তাদের কাছে প্রতারণা করে মহিষের মাংসকে গরুর মাংস আর ভেড়াকে ছাগল (খাসি) বলে বিক্রি করে আসছে। কারণ মহিষের মাংসের দাম আমাদের দেশে তুলনামূলক গরুর মাংসের চেয়ে কম হওয়ায় ভোক্তাদের অনেকের মধ্যে মহিষের মাংস সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে।
যদিও গুণে ও মানে গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি ও বেশ স্বাস্থ্যসম্মত। হয়তো এ কারণে চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় মহিষের মাংস বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকে গরুর পরিবর্তে মহিষ দিয়ে কোরবানিও দিতে পছন্দ করে। অবশ্য বিভিন্ন শহরে প্রতিদিন অনেক মহিষ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু মহিষের মাংস কিনতে গেলে পাওয়া যায় না। মূলত মাংস ব্যবসায়ীরা রাতে গোপনে মহিষ জবাই করে গরুর মাংস হিসেবে সিল মেরে ঝুলিয়ে রাখে।
মহিষ জবাইয়ের পর প্রথমেই গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে শিং উঠিয়ে শরীর থেকে চামড়া খুলে নেওয়া হয়। পরে তা বিভিন্ন দোকানে গরুর মাংস হিসেবে সরবরাহ করা হয়। ভেড়া জবাইয়ের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে গরু ও খাসির মাংস বলে প্রমাণ করার জন্য মাংস বিতানের সামনে গরু ও ছাগলের মাথা, চামড়াসহ বিভিন্ন আলামত রাখা হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, গুণগত মানের দিক দিয়ে গরুর দুধ ও মাংসের তুলনায় মহিষের দুধ ও মাংস বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। মহিষের দুধে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মহিষের দুধ ঘন ও ননিযুক্ত হওয়ায় এটি ইয়োগার্ট বা দই, পনির, ননিযুক্ত মিষ্টি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
এ ছাড়া ঘি, মাখনসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনেও এর জুড়ি নেই। এ ছাড়া গরুর দুধের তুলনায় মহিষের দুধ অনেক বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়। মহিষের মাংসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ মুরগির চেয়েও কম। এতে ক্যালরি ও প্রয়োজনীয় চর্বিজাতীয় উপাদান গরুর দুধের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ভিটামিনের উপস্থিতির কারণে মহিষের দুধ গরুর তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক।
মূলত গরুর বিকল্প হিসেবে মহিষ পালনের সুবিধা বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য মহিষের দুধ তুলনামূলক অনেক বেশি উপযোগী। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সার্বিক অবদানের গুরুত্ব বিবেচনায় মোটামুটি ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই গরুর পরেই মহিষের স্থান। গরুর চেয়ে আকারে বড় হওয়ার কারণে মহিষ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি মাংস পাওয়া যায়। শস্য উৎপাদনে কর্দমাক্ত জমি চাষের জন্য গরুর চেয়ে মহিষ বেশি উপযোগী।
ভারত উপমহাদেশ মহিষের দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিচিত। এজন্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতের মহিষকে দুধ উৎপাদনের মেশিন বলা হয়। গরু পালনের তুলনায় মহিষ পালন তুলনামূলক সহজ আর কম ব্যয়বহুল। গরু পালনের খরচের তুলনায় মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থান এবং খাদ্য খরচ অনেকটা কম। কারণ মহিষ বালুচর আর নদীবিধৌত বাথান এলাকায় সবুজ ঘাস খেয়ে থাকে। গরুর তুলনায় মহিষের রোগবালাইও অপেক্ষাকৃত কম।
মহিষ গরম সহ্য করতে পারে না এ কারণে কাদামাটি ও পানিতে গড়াগড়ি করতে পছন্দ করে। আরামের জন্য পানি আর ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকতে আরাম বোধ করে। দিনের মধ্যভাগে এবং সূর্যাস্তের কিছুটা আগে মহিষকে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাদাপানিতে গড়াগড়ি করে অবস্থান করতে হয়। মহিষ গড়ে ১৫ বছর বাঁচে এবং সমগ্র জীবণচক্রে প্রায় ১৬-১৭টি বাচ্চা দিয়ে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক মহিষ পালনে যারা ইচ্ছুক তাদের উল্লিখিত এসব তথ্য জানা থাকা ভালো।
আরও পড়ুনগরু ও মহিষ প্রাণিসম্পদ খাতের দুটি প্রধান গবাদি পশুর জাত। পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি প্রাণী মহিষ। তাই এই মহিষের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার ১৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দের পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।
২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি দেশের ৮টি বিভাগের ৪৯টি জেলার ২০০টি উপজেলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করবে। দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মহিষের জাত উন্নয়ন এবং মহিষের সংখ্যা বাড়ানো, দুগ্ধ উৎপাদনে মহিষের ভূমিকা জোরদার, আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, মহিষ খামারিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং মহিষজাত খাদ্যপণ্য গ্রহণে জনসচেতনতা বাড়াতেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
মহিষের মাংসের উপকারিতা সম্পর্কিত:
গরুর চেয়ে মহিষের মাংস পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, গুণগত মানের দিক দিয়ে গরুর মাংসের তুলনায় মহিষের মাংস বেশি স্বাস্থ্যসম্মত।
মহিষের মাংস হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
গরুর মাংস খেলে অনেক ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা মহিষের মাংসে একেবারে নেই বল্লেই চলে। গরুর মাংসে অনেক ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে যেমন হার্টের সমস্যা হতে পারে, এলার্জির সমস্যা হতে পারে, কোলেস্টেরলের সমস্যা হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে মহিষের মাংস তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি নিরাপদ।
গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও, মহিষের মাংসে তা মাত্র ২ শতাংশ। মহিষের মাংসে চর্বির পরিমাণ কম থাকায় অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। মহিষের মাংসে গরুর মাংসের তুলনায় আয়রন বেশি থাকায় মানুষের দেহে রক্ততৈরী এবং রক্তস্বল্পতা (লো প্রেশার) প্রতিরোধে সহায়ক।
যারা বাত ব্যাথার ভয়ে গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, তারা নির্ভয়ে মহিষের মাংস খেতে পারবেন। মহিষের মাংসে গরুর গোস্তের চেয়ে ৪০% কোলেস্টেরল কম, ১১% আমিষ বেশি ও ১০% মিনারেল বেশি থাকে।
এই মাংসে ভিটামিন বি-১২ এর পরিমাণ অনেক বেশি যা শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ও মানসিক বৃদ্ধি বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
মহিষের মাংসে গরুর তুলনায় কার্যকর আয়রন পরিমাণ বেশি থাকে। যা গর্ভকালীন মায়েদের জন্য, মায়েদের আয়রনের ঘাটতি মেটাতে অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যারা তেল-চর্বি এড়িয়ে চলেন তাদের জন্য মহিষের মাংসের বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন


_medium_1764764296.jpg)

_medium_1764681341.jpg)




