বগুড়ার নন্দীগ্রামে মানসিক ভারসাম্যহীন সোহেলের মানবেতর জীবন
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি : সন্ধ্যা নামলেই নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পিএস ফার্মেসির এক কোণে দেখা মেলে এক কিশোরের ময়লা জামা গায়ে, চোখে শূন্য দৃষ্টি, মুখে কোনো কথা নেই। কেউ খাবার দিলে খায়, না দিলে না খেয়েই থাকে। বয়স আনুমানিক ১৫ বছর। নাম তার সোহেল রানা, তবে স্থানীয়দের কাছে সে পরিচিত ‘সোহেল পাগলা’ নামে।
বাবার বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার নিমা কদমা গ্রামে। সোহেলের বাবা আহাদ জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে চলে আসেন বগুড়ার নন্দীগ্রামে এবং এখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। জন্মের পরপরই সোহেল হারায় বাবা আব্দুল আহাদকে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আছিয়া বেগম ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন।
ছিল না কোনো স্থায়ী ঠিকানা-কখনও এক বাড়ির বারান্দায়, কখনও অন্যের উঠোনে রাত কাটাতেন মা-ছেলে। দুই সন্তানÑমেয়ে হিরা খাতুন ও ছেলে সোহেল রানাকে কষ্ট করে মানুষ করেন তিনি। মেয়ে হিরাকে ছোটবেলা থেকেই অন্যের বাড়িতে কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন, আর মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে সারাক্ষণ সঙ্গে রাখতেন। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আছিয়া বেগম মারা যান প্রায় বিনা চিকিৎসায়। মায়ের মৃত্যুর পর একেবারে একা হয়ে পড়ে সোহেল।
ছোটবেলা থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন সোহেলকে মা কখনও অবহেলা করেনি। যত কষ্টই হোক পাশে রেখেছেন। এখন মা নেই তাই তার কোনো ঠিকানাও নেই। কখনও দোকানের বারান্দায়, কখনও রাস্তার ধারে রাত কাটায় সে। স্থানীয়রা জানান, একসময় সোহেল অনেক উচ্ছৃঙ্খল ছিল রাস্তার মানুষের কাছ থেকে জোর করে জামা-কাপড় কিনে নিত বা খাবার কিনে নিত। এতে অনেকেই বিরক্ত হয়ে তাকে মারধরও করত। তবে মায়ের মৃত্যুর পর এখন সে অনেক শান্ত, আর কাউকে বিরক্ত করে না।
সোহেলের বোন হিরা খাতুন বলেন, আমরা খুব গরিব মানুষ। মা ঝিয়ের কাজ করত। মা মারা যাওয়ার পর ভাইটা অনেক শান্ত হয়ে গেছে। ও সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়, কিন্তু তাতে চিকিৎসা হয় না। আমি নিজের সংসারে ব্যস্ত থাকায় সবসময় খোঁজ নিতে পারি না। আমার ভাইটা যেন চিকিৎসা পায়, সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারে এই আশা করছি। সমাজের বিত্তবানরা যদি একটু সাহায্য করেন, তাহলে হয়ত ওর জীবনটা বাচাঁনো যাবে।
আরও পড়ুনস্থানীয় ব্যবসায়ী ফিজার আলী বলেন, সোহেল মাঝে মাঝে আমার দোকানের সামনে বসে থাকে। আমরা যতটুকু পারি সাহায্য করি। ওর চিকিৎসা দরকার। ওষুধ ব্যবসায়ী সবুজ প্রামাণিক বলেন, সোহেল আগে খুব পাগলামি করত, এখন অনেক স্থির। নিয়মিত চিকিৎসা পেলে হয়তো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। সাবেক কাউন্সিলর আবু সাঈদ মিলন জানান, সোহেলের আবস্থা আমাদের জানা। জন্মের পর থেকেই সোহেল মানসিক ভারসাম্যহীন।
তার মা দীর্ঘদিন আমাদের এলাকায় ছিলেন। আমরা যতটুকু পারি সহযোগিতা করেছি। তবে স্থায়ী চিকিৎসার জন্য বড় উদ্যোগ দরকার। এজন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ইকবাল মাহমুদ লিটন বলেন, সরকারি মানসিক হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা পেলে সোহেলের অবস্থার উন্নতি সম্ভব।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, সোহেল প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় রয়েছে। তবে সমাজের সচেতন মানুষ ও স্থানীয় সংগঠনগুলো যদি পাশে আসে, তাহলে তার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
মানুষ মানুষের জন্য এই বিশ্বাসই হয়তো একদিন ফিরিয়ে দেবে সোহেল রানার জীবনে নতুন আলো। সোহেলের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য উপজেলা সমাজসেবা অফিস বা নন্দীগ্রাম বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন পিএম ফার্মেসীতে যোগাযোগ করে তাকেসহায়তা করা যাবে।
মন্তব্য করুন









