আজ নন্দীগ্রাম হানাদারমুক্ত দিবস
নন্দীগ্রাম (বগুড়া) প্রতিনিধি : আজ ১৩ ডিসেম্বর বগুড়ার নন্দীগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে নন্দীগ্রামকে শত্রুমুক্ত করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেদিনের সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৩ ডিসেম্বরের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার লড়াই।
পাকসেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে টানা কয়েকদিনের প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে নন্দীগ্রাম পুরোপুরি মুক্ত হয়। তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ইউপি, ডেরাডুন সাব-ডিভিশনের ভান্ডুয়া সামরিক কেন্দ্রের ৭ নম্বর সেক্টরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর হিলি সীমান্ত হয়ে দেশে প্রবেশ করে পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন।
বাংলাদেশে প্রবেশের পর নন্দীগ্রামমুখী অভিযানে প্রথম বড় সম্মুখযুদ্ধ হয় কাহালুর কড়ই বামুজা গ্রামে। সেখানে মুখোমুখি লড়াইয়ে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নন্দীগ্রামে প্রবেশ করেন এবং তিন দফা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথমে নন্দীগ্রাম পূর্ব পাড়ার মন্ডল পুকুর সি অ্যান্ড বি সড়কের পাশে থেকে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের ওপর আক্রমণ করেন।
ওই দিন উপজেলার রণবাঘা বড় ব্রীজের নিকট রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়েছিলো। অপরদিকে বেলঘরিয়ায় পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে পাক বাহিনীর একজন সেনা সদস্য ‘পুন্ন খান’ আত্মসমর্পণ করে। পরে কমান্ডার আবু বক্করের মাধ্যমে তাকে বগুড়া সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় উপজেলার চাকলমা গ্রামের আকরাম হোসেন, বাদলাশন গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদ, রুস্তমপুর গ্রামের মহিউদ্দিন (মরু মন্ডল), ভাটরা গ্রামের আব্দুস সোবহান, হাটকড়ই গ্রামের ছমির উদ্দিন ও তার দুই ছেলে আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুর রশিদকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আরও পড়ুনসবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা ঘটে বামনগ্রামে। সেখানে নয়’জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে গণকরব দেয় তারা। এই হত্যাকান্ডগুলো আজও নন্দীগ্রামের মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে রয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। ৬ ডিসেম্বর রাতে কাহালুর নরহট্র হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে থানা-ওয়ারী দায়িত্ব বণ্টন করেন। নন্দীগ্রাম থানার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান আবু বক্কর। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা পায়ে হেঁটে নন্দীগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে প্রথমে দারিয়াপুর গ্রামে রাতযাপন করেন।
পরবর্তী কয়েকদিন আত্মগোপনে থেকে তারা থানা ও আশপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে নন্দীগ্রাম থানা আক্রমণ করেন। এসময় প্রায় দুই শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে ভয়াবহ লড়াই হয়। এই যুদ্ধে ৮০ জন রাজাকার আটক হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ি যুদ্ধটি ঘটে থানার পূর্ব-দক্ষিণ মাঠ ডাকনীতলায় যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পাকবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে, আর মুক্তিযোদ্ধারা সীমিত অস্ত্র নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান।
ঠিক তখনই থানার উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে দুইটি ফাইটার বিমান পাকবাহিনীর অবস্থানে ব্রাশ ফায়ার ও বোমা বর্ষণ শুরু করলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়েই নন্দীগ্রাম হানাদার মুক্ত হয় এবং সব বাধা পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। চারদিকে মুক্তির উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তির আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠে নন্দীগ্রামের মানুষ। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিট কমান্ড বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করে আসছে।
মন্তব্য করুন








