সস্তা প্লাস্টিকের খেলনা কিনে অভিভাবকরা শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছে বিষ
শাওন রহমান : দেশের বাজারে শিশুদের খেলনা মানেই-প্লাস্টিকের রঙিন গাড়ি, হাড়ি-পাতিল, বন্দুক, ব্যাট-বল, লেটার ব্লক ইত্যাদি। বগুড়াসহ দেশের সব বাজারেই শিশুদের খেলনার বাজার দখল করে আছে এসব প্লাস্টিকের পণ্য।
এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)’র পরিসংখ্যান বলছে, দেশের খেলনা বাজারের সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশই প্লাস্টিকের দখলে। মাটির তৈরি খেলনা সামগ্রী মাত্র ১৮ শতাংশ। বাকিটা দখলে আছে-কাঠ, কাপড়, লোহা, রাবার, পাট ও সিরামিক্সের। কাঠ ১৫ শতাংশ, বস্ত্র থেকে তৈরি ৯ শতাংশ, লৌহজাত খেলনা ৭ শতাংশ, রাবারের তৈরি ৬ শতাংশ, অবশিষ্ট ৩ শতাংশ তৈরি হয় পাট ও সিরামিক্স দিয়ে।
শিশুদের মানসিক বিকাশ কিংবা চিত্ত বিনোদনের বড় অনুষঙ্গও এসব খেলনা। অথচ আনন্দের এসব উপকরণে মিশে আছে বিষাদের উপাদান। এই খেলনাই হতে পারে শিশুর ক্ষতির কারণ। দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া প্লাস্টিকের বেশিরভাগ খেলনায় মিশে আছে নানারকম ক্ষতিকর রাসায়নিক। বিষয়টি জানা নেই অনেক অভিভাবকেরই। জানা থাকলেও যেন নিরুপায়। সস্তা এসব খেলনা মাধ্যমে অভিভাবকরা শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিষ।
অভিভাবকরা বলছেন, খেলনাগুলো লোভনীয়, দেখলেই বাচ্চারা কিনতে চায়। এগুলো শিশুদের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যসম্মত প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হলে ভালো হতো। আমরা শিশুদের হাতে যে খেলনা তুলে দেই সেই খেলনাটা ভালো এবং স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা আমরা বিচার করছি না। ফলে আমাদের শিশুরা অজান্তেই নানা জটিল সমস্যায় পড়ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
এসডো’র ‘টকসিক প্লে-টাইম : আনকভারিং হেভি মেটালস ইন চিলড্রেনস প্লাস্টিক টয়েজ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যে দেখা গেছে, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনার ৭০ শতাংশেই রয়েছে অতিমাত্রায় বিষাক্ত ভারি ধাতু। আর এসব খেলনায় মিলেছে-সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ উপাদান; যার মাত্রা আন্তর্জাতিক নিরাপদ সীমার চেয়ে ১০-৭০ গুণ পর্যন্ত বেশি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারখানায় বেশিরভাগ প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হচ্ছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে। কারখানাগুলোতে মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যসম্মত বিধি। কী পরিমাণ রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকবে তা নিয়েও নেই কোন সচেতনতা। প্রকৃতপক্ষে প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে নেই কোন নির্দেশনা বা নীতিমালা।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে খেলনার জন্য কোনো বাধ্যতামূলক রাসায়নিক নিরাপত্তা আইন নেই। নেই কোনো লেবেলিং, পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা কিংবা রিকল (প্রত্যাহার) ব্যবস্থা। অনেক খেলনা তৈরি হচ্ছে পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক দিয়ে, যেগুলো আসছে ই-ওয়েস্ট ও শিল্প বর্জ্য থেকে। একইভাবে চীন ও ভারত থেকে আসা খেলনার সঙ্গেও থাকে না কোনো রাসায়নিক নিরাপত্তা রিপোর্ট বা ট্রেসেবিলিটি।
দেশে বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই জানায়, তাদের অধীনে সাড়ে ৪ হাজার স্ট্যান্ডার্ড থাকলেও মাত্র ২৯৯টি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক। তবে স্থানীয়ভাবে শিশু খেলনা উৎপাদনকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এর আওতাভুক্ত নয়। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যদিও, তা মোকাবিলায় ক্ষতিকর প্লাস্টিকের খেলনার উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত ও মান নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসের কথা বলছে সংস্থাটি।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক আর পলিথিন কিন্তু একই জিনিস। পলিথিনের মধ্যে কিন্তু প্লাস্টিক যুক্ত থাকে। যেসব খেলনা শিশুরা মুখে ব্যবহার করে সেগুলো প্লাস্টিক ছাড়া হয় না। এসব খেলনা ফুডগ্রেড প্লাস্টিক হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের খেলনা তৈরির সময় এই বিষয় মাথায় রাখা হয় না, এটি নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
দীর্ঘদিন শিশুরা মুখে নিতে থাকলে এটা তাদের বিপাক প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি এভাবে চলতে থাকলে ক্যান্সারের মতো পর্যায়ে যেতে পারে। তারা আরও বলছেন, প্লাস্টিকের খেলনা থেকে ছোট শিশুদের জিহ্বায় ঘা হয়ে যায়, ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়। খেলনা থেকে ময়লা মুখে গেলে পেটে পীড়া, ডায়রিয়া হতে পারে।
প্লাস্টিক বেশি সময় মুখে থাকলে দাঁতেরও ক্ষতি হতে পারে। আবার প্লাস্টিক বেশি দিন গ্রহণ করলে কিডনি কিংবা লিভারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের ফিডারে খাওয়ানো হয়। ফিডার থেকে মুখে ঘা হয়, সামনের রাবারটার (নিপল) জন্য। পেটের জন্য খারাপ, কারণ ফিডারে খাবার খাওয়ার সময় পেটে বাতাস ঢুকে যায়।
মন্তব্য করুন










