তিস্তার পানির অধিকার

অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে এক তরফা পানি উত্তোলনের ফলে এ সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। অন্যদিকে, এই সংকট সমাধান না হওয়ার পেছনে ভারতের এক তরফা মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। তিস্তার পানির ‘ন্যায্য হিস্যা’ বুঝে না পাওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা বাড়ছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের দু:খ তিস্তার পানি বন্টন সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে এই সংকট ততই বাড়বে।
সম্প্রতি রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও ন্যায্য পানির হিস্যার দাবিতে ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাচাই’ বিষয়টি সামনে এসেছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও রংপুরের ১১ স্থানে এক যোগে প্রতিবাদ আর ক্ষোভের আগুনে মশাল প্রজ্জলন করে নদী অববাহিকা জুড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষ। এতে নেতৃত্ব দেন তিস্তা নদী রক্ষা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু।
তিস্তা পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুব্ধ মানুষ বলেন ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে, যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আমাদের এই অঞ্চলে। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদী বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহায়ক এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অথচ এই সংকটের সমাধান হচ্ছে না-তা প্রতিবেশি দেশের কাছে কাম্য হতে পারে না।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। সেটি কোনোভাবেই সফল হয়নি। বিগত পতিত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণে ভারত বাংলাদেশের এই পানি সমস্যাকে কোন পাত্তাই দেয়নি। মনে রাখা দরকার, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। ভারত কিছুতেই এ নদী থেকে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় এককালের প্রমত্তা পদ্মা আর নেই। শীতকালে শুকিয়ে যায়। গরুর গাড়ি এপার-ওপার করে।
মানুষও হেঁটে পারাপার হয়, ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রমত্তা পদ্মাকে খেয়ে ফেলেছে। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের অনেক কিছুই আজ কেবল স্মৃতি। বড় বড় স্টিমার চলাচল করতো নদীগুলোতে। নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কারণে উত্তরবঙ্গের অনেক বন্দর ছিল জমজমাট। এখন বছরের বেশির ভাগ সময় নদী দুটি শুকিয়ে থাকে। নৌকাও চলতে পারে না। ভারতের গজলডোবা বাঁধ নদী দুটির এ অপমৃত্যুর কারণ। নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মরছে নদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশও। উত্তরবঙ্গে শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। শস্য উৎপাদনে পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে।
আরও পড়ুনশুস্ক মৌসুমে গভীর নলকূপেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা বাংলাদেশের অর্ধ শতাধিক নদীরই আজ এমন দুরবস্থা শীতকালে বেশির ভাগ নদীতে পানি প্রবাহ থাকে না। ফলে দক্ষিণ বঙ্গে সমুদ্রের নোনা পানি ক্রমেই দেশের অভ্যন্তরে বিস্তৃত হচ্ছে। সেখানেও কৃষি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এটা আজ অবধারিত সত্য যে অভিন্ন নদীগুলোর পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ক্রমেই হুমকির মুখে পড়বে। অথচ দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে দীর্ঘকাল ধরে আলাপ-আলোচনা চললেও বাংলাদেশের জন্য কোনো সুখবর তৈরি হয়নি। বরং দু:সংবাদই আসছে বেশি। ভারত অভিন্ন নদীগুলোর উজানে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ‘দু:খ’ তিস্তা নদীর পানি বন্টন সংক্রান্ত সমস্যা অনেক পুরনো। অভিন্ন এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশের অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায় না। ফলে, প্রতিবেশি দেশের কারণে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে, কীভাবে ‘বন্ধুসুলভ’ সম্পর্ক হয় সেই প্রশ্ন এসে যায়। বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসছে। এখন ভারতপ্রেমি নতজানু ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় নেই।
তাই আমাদের সুযোগ এসেছে এখন তিস্তার ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেওয়ার। ভারত এক তরফা পানি প্রত্যাহার বন্ধ না করলে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ এর বিচার চাইতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে পঞ্চাশ দশকে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু সমাধান হয়েছিল। দ্বি-পাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যে এ সমস্যার সমাধান হবে- এটা বাংলাদেশের জনগণ এখন আর বিশ্বাস করে না।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তিস্তার পানি বন্টন সংকট নিরসন হবে এবং বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা বুঝে পাবে- এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন