ভিডিও বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বগুড়ায় ভয়ঙ্কর ‘হানি ট্র্যাপ’ : টার্গেট বিত্তবান থেকে সাধারণ মানুষ

বগুড়ায় ভয়ঙ্কর ‘হানি ট্র্যাপ’ : টার্গেট বিত্তবান থেকে সাধারণ মানুষ। Ai তৈরিকৃত প্রতীকী ছবি

মাসুদুর রহমান রানা : প্রথমে ফেসবুকে বন্ধুত্ব ও কথোপকথন, তারপর ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা। সেই আলাপচারিতার ভিডিও চিত্র ধারণ করে নানাভাবে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ধারাবাহিক এ কর্মযজ্ঞ চালায় এক শ্রেণির সুন্দরী নারীরা। তাদের এমন প্রলোভনের শিকার হন রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষও। আর এই অপকর্মের নাম ‘হানি ট্র্যাপ’ বা ‘মধু ফাঁদ’।

বগুড়াতেও এই চক্র সক্রিয়। একে এক ফাঁস হচ্ছে ‘হানি ট্র্যাপ’র ভয়ঙ্কর কাহিনী। প্রায়ই এই ফাঁদে পড়ে অর্থ খুঁইয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। তবে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি বগুড়ার সাইবার ইউনিট কাজ করছে এসব অপরাধ নিয়ে। প্রায়ই এ ধরণের অভিযোগ আসছে সাইবার ইউনিটে। ডিবি’র হাতে ধরা পড়ছে হানি ট্রাপে জড়িত অপরাধীরা।

ডিবি’র সাইবার ইউনিট সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে হানি ট্রাপের ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে হানি ট্রাপে জড়িত হাফডজন নারীসহ ১৭ জন। সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট রাতে বগুড়া শহরের চকসূত্রাপুর পাঁচতলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে  ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলে দুই ব্যক্তিকে জিম্মি করে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আসছিল একটি প্রতারক চক্র।

পরে খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের একটি টিম সেখানে অভিযান চালিয়ে জিম্মিদের উদ্ধার করে এবং এ ঘটনায় জড়িত তিন নারীসহ চক্রের সাতজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত হলো-শহরের চেলোপাড়ার মহসিন কাজি সিজান (২৫), চকসূত্রাপুর চামড়াপট্টির মতিন সরকারের ভাই ওমর সরকার (৩৫), কেয়া বেগম (৩৩), আফসানা মিমি (২৪), কামরুন্নাহার অধোরা (২২), এনামুল হোসেন ওরফে রায়হান (২৭) ও নয়ন হোসেন (৩৫)।
বগুড়া ডিবি’র ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. ইকবাল বাহার জানান, জয়পুরহাটের ফজলুর রহমান (৪৪) কিছুদিন আগে তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে হানি ট্র্যাপ চক্রের সদস্য কেয়া বেগমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে মোবাইল নম্বর বিনিময় করা হয়।

গত ২৮ আগস্ট সকালে কেয়া ফোন করে ফজলুর রহমানকে বগুড়া শহরের তিনমাথা এলাকায় আসতে বলে। সেখানে তিনি এলে কেয়া ও সহযোগীরা তাকে চকসূত্রাপুরের ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আটকে রাখে। আবার কিছুক্ষণ পর তার আরও এক সহযোগীকেও সেখানে ডেকে আটকিয়ে রাখা হয়। তারা তাদের জিম্মি করে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে ডিবি জিম্মি দশা থেকে তাদের উদ্ধার এবং ওই সাতজনকে গ্রেফতার করে।

ডিবি’র সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর রাকিব হোসেন বলেন, বগুড়াতেও বাড়ছে এ ধরণের অপরাধ। প্রতারক চক্র মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে এক শ্রেণির সুন্দরী তরুণীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ‘হানি ট্রাপে’ ফেলছে। ইতোমধ্যে বগুড়ার রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, স্বনামধন্য ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তারা এ ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তবে বগুড়ায় এই প্রতারক চক্রে কতজন সদস্য সক্রিয় আছে, তা না জানা গেলেও ডিবি ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে নারীসহ ১৭ জনকে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) হোসাইন মুহাম্মদ রায়হান বলেন, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আর কাউকে পেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, প্রতারকদের ধারণা সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা বাইরে এলে তাদের চাকরি হারানোর শঙ্কা থাকে। চাকরি হারানোর ভয় থেকে তাদের কাছে যা চাওয়া হয় তা তারা দিয়ে দেন। তিনি বলেন, হোয়ার্টস অ্যাপে কোন অপরিচিত কোন নারী যদি ভিডিও কল দেয় তা ধরবেন না।

আরও পড়ুন

কল ধরলেই বিপদে পড়বেন। এটি স্ক্রিনশট দিয়ে রেখে আপনাকে ভয় দেখিয়ে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেবে। তাই সাবধান হতে হবে নিজ থেকেই। তিনি বলেন, এ ধরনের ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষেত্রে প্রতারকরা ব্যক্তির আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে। তাদের যেহেতু টাকা দেওয়ার সামর্থ আছে এবং সামাজিক মর্যাদা রক্ষার চাপ থাকে, এ কারণে সহজেই তারা প্রতারকদের দাবি করা টাকা দিয়ে দেন।

তিনি আরও বলেন, প্রতারক চক্রের ওই নারীরা ফেসবুকে নিজের আবেদনময়ী ছবি ও টিকটকে ভিডিও পোস্ট করবে। উচ্চবিত্তদের টার্গেট করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফেলবে প্রেমের জালে। পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও, অডিও এবং ভিডিওতে হওয়া কথোপকথন রেকর্ড করে ব্লাকমেইল করে হাতিয়ে নিবে মোটা অঙ্কের টাকা। এ কারণে এসব থেকে সাবধান থাকতে হবে। তিনি বলেন, নিজে যদি ধরা না দেন কেউ আপনাকে বিপদে ফেলতে পারবে না। তাই এই সব নারী থেকে নিজে দূরে থাকতে হবে।

ডিবি’র সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর রাকিব হোসেন আরও বলেন, ‘হানি ট্র্যাপে’র ঘটনায় মামলা হচ্ছে। তবে এর সংখ্যা খুব কম। ঘটনার শিকার ৯০ শতাংশই মামলা করেন মানসম্মানের ভয়ে। তিনি বলেন, হানি ট্র্যাপ চক্রের নারীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে শীর্ষ ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে থাকে।

এরপর বিভিন্ন পরিচয়ে কল বা মেসেজ দিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। একটু ঘনিষ্ঠ হলে অসামাজিক কাজের উদ্দেশ্যে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হয় সহযোগী প্রতাকরা। ওই প্রতারকরা নিজেকে সাংবাদিক কিংবা পুলিশ পরিচয় দিয়ে নির্জন কক্ষে তাদের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। সেই ছবি ও ভিডিও পরিবারের কাছে অথবা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আরও বলেন, হানি ট্র্যাপের মতো ঘটনা ঘটলে ভয় না পেয়ে পুলিশের সাইবার ইউনিটের সহযোগিতা নিতে হবে। পাশাপাশি অপরিচিতদের সঙ্গে একান্ত আলাপ বা ভিডিও কল করা যাবে না। ‘সবার প্রতি অনুরোধ, অপরিচিত আইডি থেকে কোনো এসএমএস বা মেসেজ আসলে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার দরকার নেই। বন্ধুত্ব করলেও সেক্ষেত্রে সাবধানে কথা বলতে হবে।

কারও প্রতি বিশ্বাস করে গোপন চ্যাট বা ভিডিও কলে কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। কারও সঙ্গে যদি এমন ঘটনা ঘটেই যায়, তাহলে কোনোভাবে টাকা দেওয়া যাবে না। টাকা দিলে প্রতারকরা বুঝবে ওই ব্যক্তির কাছে টাকা আছে। তখন তারা বারবার ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবে। কেউ যদি এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন অবশ্যই তাকে সাইবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভালো মুনাফার স্বপ্নে বিভোর লালমনিরহাটের শিম চাষিরা

বগুড়ায় আগুনে তিনটি বাড়ি পুড়ে ছাই, পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত

ঠাকুরগাঁওয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জরিমানা ও সিলগালা, নানা অনিয়ম

লালমনিরহাটে চায়না দুয়ারী জালের ফাঁদে বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ

বগুড়ার মোকামতলায় ১০ কেজি গাঁজা ও ২৫ বোতল ফেন্সিডিলসহ গ্রেফতার দুই

রাজশাহীতে ৯টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল, শেখ হাসিনাসহ আসামি ৫২৯