‘বাকরখানি’ আর করুণ প্রেমকাহিনি!

বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো খাবার ‘বাকরখানি’র নাম। শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্য নয়, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক করুণ প্রেমকাহিনিও। ত্রিভুজ প্রেমের সে কাহিনি কি আপনি জানেন?
পুরান ঢাকার অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে অন্যতম একটি খাবার হলো ‘বাকরখানি’। সকাল কিংবা বিকেলের নাশতায় চায়ের সঙ্গে এ খাবারের জনপ্রিয়তা অনেক। ভোজন রসিকরা এ খাবার যেমন পছন্দ করেন তেমনি জানতে চান খাবারের উৎপত্তির ইতিহাসও। কীভাবে এর নাম ‘বাকরখানি’ হলো; পেছনে লুকিয়ে থাকা সে গল্পও জানতে চান কেউ কেউ।
জনশ্রুতি রয়েছে, মুঘল আমলে এ খাবারের চল ঢাকায় আসতে শুরু করে। আবার ইতিহাস নির্ভর বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, এ খাবারটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর দত্তকপুত্র আগা বাকের খাঁর নাম।
নাজির হোসেনের লেখা ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ বইয়ে ‘বাকরখানি’ নামের সঙ্গে করুণ এক প্রেমকাহিনির উল্লেখ করা হয়েছে। জানতে চান, কী সেই করুণ প্রেমকাহিনি?
বইটি থেকে জানা যায়, সুবাদার শাসনের সময় বাংলার মসনদে ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। ওই সময় তুরস্কের অধিবাসী তরুণ আগা বাকের ভাগ্যের অন্বেষণে আসেন ভারতবর্ষে। যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে মুর্শিদকুলি খাঁর সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন তিনি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁর কোনো সন্তান না থাকায় তিনি বাকেরকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। কথিত আছে, এ পালক পুত্রই তখনকার বিখ্যাত গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী খনি বেগমের প্রেমে পড়েন।
তাদের প্রেমকাহিনি শুরুর দিকে জীবনে সুখ আর আনন্দ নিয়ে আসলেও শেষটা ছিল বিরহে ভরা। মৃত্যু দিয়ে প্রেমের সম্পর্ক শেষ হয় তাদের।
বইটিতে লেখা, উজিরে আলা জাহান্দর খাঁর পুত্র জয়নুল খাঁও খনি বেগমের প্রেমে পড়েন। এ নিয়ে বাকেরের সঙ্গে লড়াই বাঁধলে জয়নুল খাঁ পালিয়ে যান। কিন্তু সে রটিয়ে দেন যে, বাকের জয়নুলকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন।
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বাকেরকে শাস্তি দেন। তাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচায়।
বাকেরের বন্দি দশার সময়টা কাজে লাগায় উজির পুত্র জয়নুল। ওই সময় খনি বেগমকে অপহরণ করে ভাটি বাংলার গহীন অরণ্যে পালিয়ে যান। সেখানে খনি বেগমকে তার প্রেমে কিছুতেই রাজি করাতে না পারলে আটকে রাখেন চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বরিশাল)।
এ খবর বাকেরের কানে পৌঁছাতেই তিনি ক্ষুধার্ত ও হিংস্র বাঘের সঙ্গে লড়াই শুরু করেন। বাঘটিকে মেরে বিজয়ী হয়ে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসেন।
এরপর সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে ছোটেন খনি বেগমকে মুক্ত করতে। জয়নুল খাঁর বাবাও ছেলের অপকর্মের কথা জানতে পেরে তাকে শাস্তি দিতে চন্দ্রদ্বীপে পৌঁছান। বাবার তরবারির আঘাতেই মৃত্যু হয় জয়নুল খাঁর। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত বুঝতে পেরে জয়নুল তখন তার পকেটে থাকা ছুরি বের করেন। সে ছুরি দ্রুত বসিয়ে দেন পাশে থাকা খনি বেগমের বুকে। মুহূর্তেই খনি বেগমের মৃত্যু হয়।
এ মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি বাকের। শোকে পাগলপ্রায় হয়ে যান। তখন তাকে সামাল দেন বাবা মুর্শিদকুলি খাঁ। সময়ের ব্যবধানে নিজেকে একটু সামলিয়ে খনি বেগমের স্মৃতি, অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনি আজীবন ধরে রাখতে চান হৃদয়ে। শুধু তিনিই নন, দুনিয়ার মানুষ যেন খনির সাথে তার প্রেমকাহিনির কথা জানে, ভুলে না যায় তার জন্য তিনি প্রস্তুত করেন বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত রুটি। গোলাকার রুটির মধ্যে চারটি দাগ টেনে তিনটি লম্ব স্তম্ভ তৈরি করেন। এর নাম রাখেন 'বাকের-খনি'। সে রুটিই কালক্রমে আজ মানুষের মাঝে পরিচিতি পেয়েছে ‘বাকরখানি’ নামে।
প্রসঙ্গত, বিরহী প্রেমের স্মৃতি সামলিয়ে বাকের এক সময় উমেদপুরের জমিদারি লাভ করেন। সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপের নিয়ন্ত্রণও নেন। তখন ১৭৯৭ সালে ইংরেজ শাসনামলে তার নামানুসারে বর্তমান বরিশাল জেলার নামকরণ করা হয় বাকেরগঞ্জ। এরপর বাবা মুর্শিদকুলি খাঁর উৎসাহেই বিয়ে করে সংসারী হন বাকের।
মন্তব্য করুন