দেশের তরুণরা ঘরে বসেই আয় করছেন বিলিয়ন ডলার, কিন্তু আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের অনুপস্থিতি এই সম্ভাবনার লাগাম টেনে ধরছে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের অদৃশ্য দেয়াল পেপাল
মোঃ রেজাউল করিম রাজু : বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্লায়েন্টের জন্য লোগো ডিজাইন করে ডলার আয় করছেন, তখন বুঝতে হবে প্রযুক্তির শক্তি সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। এটিই ফ্রিল্যান্সিং একুশ শতকের স্মার্ট অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি কেবল একটি আয়ের উৎস নয়, বরং মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার এক বিশাল সুযোগ। কিন্তু এই সম্ভাবনাময় যাত্রাপথে ‘পেপাল’-এর মতো একটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের অনুপস্থিতি এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেভাবে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা : ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্তপেশা এখন আর কোনো বিকল্প আয় নয়, বরং হাজারো তরুণের প্রধান পেশা। আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার ডটকমের মতো বৈশ্বিক মার্কেটপ্লেসগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা তাদের দক্ষতা বিশ্বজুড়ে বিক্রি করছেন। ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে তারা এখন উন্নত বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি কাজ করছেন।
যেসব খাতে এগিয়ে বাংলাদেশ:
- আইটি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট: ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্টে বাংলাদেশি তরুণদের দক্ষতা বিশেষভাবে প্রশংসিত।
- গ্রাফিক ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া: লোগো ডিজাইন থেকে শুরু করে ভিডিও এডিটিং ও অ্যানিমেশনের মতো সৃজনশীল কাজে আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের সুনাম রয়েছে।
- ডিজিটাল মার্কেটিং: সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন , সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং কন্টেন্ট মার্কেটিংয়ের মতো সেবা দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করছেন আমাদের মার্কেটাররা।
- সেলস ও মার্কেটিং সাপোর্ট: বাংলাদেশ এই খাতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সাপ্লায়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, রংপুরের এক কলেজছাত্র রায়হান আহমেদ। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি আপওয়ার্কে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে প্রতি মাসে প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ ডলার আয় করছেন। তার মতো হাজারো রায়হানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে শক্তিশালী করছে, যা প্রথাগত প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি এক নতুন ‘ডিজিটাল রেমিট্যান্স’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা এই খাতের বিশালতার প্রমাণ দেয়।
সরকারও এই খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড: সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি দিতে সরকার ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বিশেষ আইডি কার্ড চালু করেছে, যা ব্যাংক লোন ও অন্যান্য সুবিধা পেতে সহায়তা করে।
- প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: আইসিটি বিভাগের অধীনে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে দেশজুড়ে হাজার হাজার তরুণকে বিনামূল্যে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
- হাই-টেক পার্ক: দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে, যা ফ্রিল্যান্সার ও আইটি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
পেপালের অভাব : এত সাফল্য আর সম্ভাবনার মাঝেও একটি বড় আক্ষেপের নাম ‘পেপাল’। বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে পেপাল তাদের সেবা দিচ্ছে এবং এটি আন্তর্জাতিক লেনদেনের সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম। অনেক বিদেশি ক্লায়েন্ট, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা, কাজের পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য পেপালকেই প্রাধান্য দেন।
পেপাল না থাকায় যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়:
১. ক্লায়েন্ট হারানো: অনেক ক্লায়েন্ট অন্য কোনো পেমেন্ট পদ্ধতিতে অভ্যস্ত নন। ফলে পেপালের বিকল্প প্রস্তাব করলে তারা বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের সাথে কাজ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
২. জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া: বর্তমানে পেওনিয়ার, ওয়াইজ (সাবেক ট্রান্সফারওয়াইজ) বা সরাসরি ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা আনতে হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো তুলনামূলকভাবে জটিল এবং এতে প্রায়ই অতিরিক্ত চার্জ বা হিডেন ফি দিতে হয়। মুদ্রা বিনিময়ের হারেও ফ্রিল্যান্সাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আরও পড়ুন৩. আস্থার সংকট: পেপালের মতো একটি স্বীকৃত প্ল্যাটফর্ম না থাকায় বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে পেমেন্ট নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দেয়।
৪. ক্ষুদ্র লেনদেনে অসুবিধা: ছোট অংকের পেমেন্ট (যেমন: ১০-২০ ডলার) আনার ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমে খরচ অনেক বেশি। পেপালে এই ধরনের লেনদেন খুব সহজ ও সাশ্রয়ী, যা নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বাংলাদেশে পেপাল সেবা চালু করা যায়, তবে ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয় বর্তমানের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি কেবল ফ্রিল্যান্সারদের ব্যক্তিগত আয় বাড়াবে না, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও শক্তিশালী করবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়
‘বাংলাদেশ 2.o’ বিনির্মাণের যে রূপকল্প সরকার হাতে নিয়েছে, তার অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে এই ফ্রিল্যান্সিং খাত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা , মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স এবং ব্লকচেইনের মতো নতুন প্রযুক্তিতে যদি আমাদের তরুণদের দক্ষ করে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের পক্ষে গিগ ইকোনমিতে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।
এগিয়ে যাওয়ার পথ:
- পেপাল আনার কূটনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ: সরকারের পক্ষ থেকে পেপাল কর্তৃপক্ষের সাথে কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে দেশের জন্য এই সেবাটি চালু করার জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। মানি লন্ডারিং বা অন্য কোনো ঝুঁকির কথা বলা হলেও, সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যেমনটি বিশ্বের অন্যান্য দেশ করেছে।
- উন্নত প্রশিক্ষণ: শুধুমাত্র বেসিক প্রশিক্ষণে সীমাবদ্ধ না থেকে, ডেটা অ্যানালিটিক্স, সাইবার সিকিউরিটি, ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো উচ্চ চাহিদার বিষয়গুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যে কেউ যেকোনো জায়গা থেকে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশের তরুণরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে শুধু নিজেদের ভাগ্যই পরিবর্তন করছে না, তারা দেশের অর্থনীতির জন্যেও বয়ে আনছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এই ‘ডিজিটাল বিপ্লব’-কে পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছে দিতে পেপালের মতো প্রতিবন্ধকতা দূর করা অপরিহার্য। সঠিক নীতিগত সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সহজলভ্য করা গেলে ফ্রিল্যান্সিং হয়ে উঠবে ‘বাংলাদেশ 2.o’ গড়ার এক অদম্য ইঞ্জিন, যা লক্ষ লক্ষ তরুণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।
মন্তব্য করুন

আইটি ডেস্ক





_medium_1761565780.jpg)



