২১ বছরের মধ্যে পাশের হার সবচেয়ে কম
সব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততাকে দায়ী করছেন শিক্ষা গবেষকরা
_original_1760629679.jpg)
স্টাফ রিপোর্টার: উচ্চ মাধ্যমিকে প্রায় ২১ বছর পর ফল বিপর্যয় ঘটেছে। ফল পর্যালোচনা করে বিপর্যয়ের মূল কারণ ইংরেজি এবং গণিতকে দায়ী করা হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা গবেষকদের মিশ্র দাবিতে উঠে এসেছে দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
ফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর ফেল করেছেন ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন, যা গত বছরের চেয়ে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন কম। দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেননি। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের পাসের হার শূন্য। গত বছর শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৫টি। আবার শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে এক হাজার ৪৩টি। সার্বিক দিক বিবেচনায় এবার ভয়াবহ ফল বিপর্যয় ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২০০২ সাল পর্যন্ত ডিভিশন পদ্ধতি অর্থাৎ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ছিল। ২০০৩ সাল থেকে জিপিএ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা হয়, যেখানে পাঁচটি স্কেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। নতুন এ পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষার্থীদের বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে। জিপিএ পদ্ধতি চালুর প্রভাব পড়ে ২০০৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে। সে বছর পাসের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০০৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশে। এরপর থেকে পাসের হার ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছিলেন ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ২০০৬ সালে পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৬৫, ২০০৭ সালে ৬৫ দশমিক ৬০, ২০০৮ সালে ৭৬ দশমিক ১৯, ২০০৯ সালে ৭২ দশমিক ৭৮, ২০১০ সালে ৭৪ দশমিক ২৮, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ০৮, ২০১২ সালে ৭৮ দশমিক ৬৭, ২০১৩ সালে ৭৪ দশমিক ৩০, ২০১৫ সালে ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। এরপর ২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সে বছর ফরম পূরণ করা সব শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়া হয়, যেটিকে অটোপাস বলা হয়।
অর্থাৎ, ২০২০ সালে পাসের হার হয় ১০০ শতাংশ। করোনার কারণে এরপর কয়েক বছর কখনো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, কখনো চার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা হয়। সে বছর পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সবশেষ ২০২৪ সালে পূর্ণ নম্বর, পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ সময়ে ফেরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। তবে কয়েকটি পরীক্ষা হওয়ার পর শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। এতে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। এ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সরকার পরিবর্তনের পর আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে পরীক্ষা আর না নেওয়ার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। তাতে বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করে। ওই বিষয়গুলোর পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসির ফলাফল বিবেচনা করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আ.ন.ম মোফাখখারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এবার ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় আন্দোলনে যুক্ত হওয়া। এরা কখনো পরীক্ষা না দিয়ে অটোপাসের জন্য আন্দোলন করেছে তো কখনো পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন করেছে। এমন কী নির্বাচনী ও পাক নির্বাচনী পরীক্ষাও না দেওয়ার জন্য এরা আন্দোলন করেছে। ফলে আন্দোলন করতে গিয়ে এরা ঠিকমত পড়ালেখা করতে পারেনি। সময়গুলো তাদের আন্দোলনের পেছনেই চলে গিয়েছে। এছাড়া এই শিক্ষার্থীরা পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) ও জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) এর মত পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। ফলে এদের পাবলিক পরীক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতাও কিছুটা কম। তাই এবার ফলাফলের বিপর্যয় ঘটেছে।
আরও পড়ুনরাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. আরিফুল ইসলামও শিক্ষার্থীদের বারবার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততাকে ফলাফল বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আন্দোলন ছাড়াও ইংরেজি ও গণিতের কারণে এবার ফল বিপর্যয়ের আরেকটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বগুড়া সরকারি মজিবর রহমান ভান্ডারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. বেল্লাল হোসেন বলেছেন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোর মত এবার কোনো খয়রাতি নম্বর না দেওয়া এবং শিক্ষা বোর্ড থেকে বেশি নম্বর প্রদানে কোনো নির্দেশনা না থাকা এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এবার ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। বগুড়া করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অসিত কুমার সরকার ফল বিপর্যয়ের কারণের অন্যতম কারণ বলেন শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল ও শ্রেণিকক্ষ বিমুখীতা, সামাজিক অবস্থাসহ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে অবাঞ্ছিত সম্পৃক্তকা। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছেড়ে কোচিং নির্ভরতা ও অতিরিক্ত সময় কোচিং সেন্টারে সময় ব্যয়। এছাড়া অধিকাংশ শিক্ষকদের শিক্ষা ব্যাণিজ্যিকীকরণও কিছুটা দায়ী।
মন্তব্য করুন