যে রাজনীতি মাথা নত করতে শেখেনি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু নাম কেবল নাম হয়ে থাকে না, তারা হয়ে ওঠে সময়ের প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম, যিনি ক্ষমতার শিখরে থেকেও মানুষের ভাষা ভুলে যাননি, আবার সংকটের গভীরে থেকেও রাষ্ট্রের মর্যাদা হাতছাড়া করেননি। তাঁর জীবন যেন এক দীর্ঘ সংগ্রামের দলিল। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকাল শুধু একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্য এক গভীর শূন্যতা। তিনি ছিলেন এমন এক নেতৃত্বের প্রতীক, যাঁর জীবন ও রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বারবার দেশের প্রশ্নে অবিচল থেকেছে। ক্ষমতার মোহ নয়, প্রতিহিংসার রাজনীতি নয়, বরং জনগণ, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদাই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল দর্শন। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়। ১৯৯১ সালে দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্ব ছিল ঐতিহাসিক ও নির্ণায়ক। সামরিক শাসনোত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল দৃঢ় এবং স্পষ্ট। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি শিক্ষা বিস্তার, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক কাঠামোর বিকাশ দেশের সামাজিক অগ্রগতিকে নতুন গতি দেয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর কূটনৈতিক ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে গেছেন। আলেম সমাজের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল, আবার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নেও তিনি ছিলেন স্পষ্ট। কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে শহরের মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। দেশকে তিনি ভালোবেসেছেন সন্তানের মতো, আর সেই ভালোবাসার রাজনীতি ছিল নির্ভেজাল ও গভীর।প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি তাঁর চরিত্রে ছিল না। দেশের প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি, কিন্তু রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করেননি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জেল-জুলুম ও নির্যাতন কোনোটিই তাঁর সংগ্রামী পথচলাকে থামাতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বারবার দেশের মানুষের কথা সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন। যে কোনো দমন-পীড়ন ও গণহত্যার ঘটনায় প্রথম সারিতে প্রতিবাদ জানানো ছিল তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের অংশ। এই স্পষ্টতা, এই সাহসই তাঁকে কেবল দলীয় নেত্রী নয়, বরং সর্বজনীন জাতীয় নেতৃত্বে পরিণত করেছে।দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কারাবরণ, অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত ত্যাগের মধ্য দিয়েও জনগণের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে অবিচল ছিলেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, স্পষ্টভাষী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। ফার্স্ট লেডি ও সেনাপ্রধানের স্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনে ব্যক্তিগত প্রাপ্তির আর কিছু বাকি ছিল না, তবু তিনি ক্ষমতার নয়, দায়িত্বের রাজনীতি বেছে নিয়েছিলেন।
আজ নেই। কিন্তু দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামের ইতিহাস থেকে যাবে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন নারী নেতৃত্ব কোনো সম্ভাবনার গল্প নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় তা এক বাস্তব শক্তি। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবদান, গণতন্ত্রের জন্য তাঁর লড়াই এবং রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁর অবস্থান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাস, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে
।
লেখক:
ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ
বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন এন্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








