শিশুদের খেলাধুলা কেনো প্রয়োজন
এক সময় বলা হতো বা এখনো বলা হয় Knowledge is power এবং এর সঙ্গে বলা হতো লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে বলা হয় Information is power আর বর্তমানে খেলাধুলার সাফল্যের জন্য বলা হয় Sports is power. সন্তানদের আমরা সবসময় বলি পড় পড়, বিদ্যালয়ে যাও, কোচিং এ যাও, বিবিধ। কিন্তু কখনো বলিনা যে, একটু খেলাধুলা কর। খেলাধুলা জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ সেটি আমরা ভুলে যাই। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য, শিক্ষায় এবং সামাজিকভাবে উন্নতি করেছে। আগে গ্রামের পর গ্রাম মাঠের পর মাঠ বা অনেক জায়গা ফাঁকা থাকত। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই কোন না কোন খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকত। হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, বউ চি, গোল্লাছুট, দৌড় ফুটবল, ভলিবল, ক্যারামবোর্ড, দাবা, লুডু, লংজাম্প, হাইজাম্প আরও অনেক খেলা প্রায় সারা বছরই লেগে থাকত। আর এখনকার চেহারাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বর্তমানে কোথাও একচিলতে জমি ফাঁকা নেই। বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ এখন শহরমুখী। নির্দিষ্ট কিছু মাঠ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু মাঠ ছাড়া কোথাও খেলাধুলা করার মতো কোন জায়গা নেই। খেলাধুলার মাধ্যমে শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ঘটে। শরীর ও মন পারস্পারিক সম্পর্ক যুক্ত। শরীর যদি সুস্থ না থাকে তাহলে লেখাপড়ায় মনোযোগ হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন স্বাস্থ্যবান শিশুর জ্ঞানধারণ ক্ষমতা স্বাস্থ্যহীন শিশুর চেয়ে অনেক বেশি। খেলাধুলা একটি শিশুর বা মানুষের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না বরং দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতা দূর করে মনকেও প্রফুল্ল রাখে। খেলাধুলা করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং মানসিক চাপ কমে। খেলাধুলাকারীদের পেশি মজবুত হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে। নিয়মিত খেলাধুলা করলে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত খেলাধুলা করলে হৃদপিন্ড ও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা সঠিক শারীরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। খেলাধুলা দেহকে কর্মক্ষম ও প্রাণবন্ত রাখে যা দীর্ঘায়ু ও কর্মোদ্যম লাভের মূল চাবিকাঠি। বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতা এবং নিয়মিত সমাবেশে অংশগ্রহণে মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ করে, যা প্রাকৃতিক ভাবেই মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা দূর করে। খেলাধুলার যে কোন প্রতিযোগিতায় জয়লাভ আত্মতৃপ্তি বাড়ায়, আবার পরাজয় মেনে নেয়ার শিক্ষা দেয়। এটি ধৈর্য সহনশীলতা ও আত্মসংযমের মতো অবস্থার বিশ্বাস সৃষ্টি করে। কোন কোন খেলাধুলায় মুহূর্তের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে যা বাস্তব জীবনে জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য করে। খেলাধুলা শিক্ষার্থীদের মাঝে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, দলগত মনোভাব ও নেতৃত্বের গুণ অর্জনে সহায়তা করে। মাঠে খেলার সময় খেলোয়াড়রা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে নিয়ম মেনে চলে এবং জয়পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে। খেলাধুলা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের সকল ভেদাভেদ ভুলে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। এটি একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের অন্যতম লক্ষ্য। তাছাড়া কোন দেশের খেলাধুলার কারণে ক্রীড়াবিদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য অর্জন করে তা সমগ্র জাতির জন্য অফুরন্ত গর্ব ও আনন্দের সঞ্চার করে এবং জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করে। খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে রাখা গেলে অলসতা, মাদকাসক্তি ও অন্যান্য অপরাধ মূলক কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে। খেলাধুলায় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে দেহের সুশক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। খেলাধুলা শুধু শরীর চর্চা নয়, শিক্ষার সাথেও খেলাধুলার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এটি একটি পুর্ণাঙ্গ বিদ্যা। সুস্থ মস্তিষ্ক একটি দেহে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলা মানব জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অধ্যায়। এটি আমাদের দেহকে করে রোগমুক্ত মনকে করে প্রফুল্ল। তাই এটি পেশাদার ক্রীড়াবিদদের জন্যই নয়, প্রতিটি নাগরিক বিশেষ করে ছাত্র ছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনে খেলাধুলাকে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। নিয়মিত খেলাধুলায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, পড়া লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ায় এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে। নিয়মিত খেলাধুলা করা শিশুদের মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা, স্মৃতি শক্তি অন্যান্যদের তুলনায় বেশি। সরকার ও সমাজের উন্নতির জন্য আরও বেশি বেশি সংখ্যক খেলার মাঠ, অবকাঠামো, খেলার সরঞ্জাম সহজলভ্য করা ও নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে খেলাধুলার প্রসার ঘটানো। তাই প্রতিদিন কিছু সময় খেলাধুলার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে, তাহলে শরীর ও মন দুটোই থাকবে সুস্থ ও সাবলীল। খেলাধুলাই পারে সুস্থ, সমৃদ্ধি ও শক্তিশালী জাতির ভবিষ্যৎ গড়তে।
এ সম্পর্কে আমাদের করণীয়ঃ গ্রামে গ্রামে বা মহল্লায় মহল্লায় সরকারি ভাবে একটি করে মাঠ তৈরি করা এবং এখানে সকল শিশুকে বিকালে খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়া। প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পাশাপাশি শারীরিক কসরত বা বিভিন্ন খেলাধুলা করার ব্যবস্থা করা এবং চালু রাখা। অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকা। বাড়ির আশে পাশে বা ভবনের চার পাশে উঁচু দেয়াল ঘেরাযুক্ত ছাদে যেখানেই একটু ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানেই শিশুদের খেলার সুযোগ করে দেওয়া। ক্রীড়া সামগ্রী সহজলভ্য করা, যেন সহজেই সকলে তা ক্রয় করতে পারে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সুস্বাস্থ্যের জন্য, মেধাবী হওয়ার জন্য মোবাইল ফোন, কোচিং ছেড়ে খেলাধুলায় অংশ নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া শিক্ষকদের প্রয়োজনে অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা করা যেন তারা আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হয়। ক্রীড়া পরিদপ্তরকে ক্রীড়া অধিদপ্তরে রুপান্তর করা এবং উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে ক্রীড়া অফিস স্থাপন করা যেন তারা উপজেলা পর্যায়ে খেলাধুলার ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সহযোগিতা করতে পারে। বর্তমানে যে সব মাঠ, স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল বা খেলাধুলার জন্য রক্ষিত স্থাপনার সুযোগ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ধারাবাহিক ভাবে খেলাধুলা চালু রাখা। ক্রীড়া খাতের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে মাঠ, স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল, খেলাধুলার স্থাপনা ইত্যাদি সংস্কার করে আকর্ষণীয় করা এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা। বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটে থাকা নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করা। খেলাধুলায় বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় ভাল মানের পুরস্কার দেওয়া এবং বিজয়ী খেলোয়াড়দেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা।
লেখক
আরও পড়ুনরমজান আলী আকন্দ
প্রাবন্ধিক ও জেলা শিক্ষা অফিসার, বগুড়া
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








-(1)-69537cfac87fa (1)_medium_1767090906.jpg)