ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য
ভেজাল আর নকল সয়লাব দেশ। চারদিকে নকল-ভেজাল ও মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি। পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ, রাজধানীর কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর ও কেরাণীগঞ্জ এলাকায় অনুমোদনহীন ও নকল রং, বৈদ্যুতিক তার ও মবিল উৎপাদনের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। অভিযানে অনুমোদনহীন ও নকল রং বৈদ্যুতিক তার ও মবিল উৎপাদন, মজুত ও বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে ভেজাল, মানহীন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য পণ্য উৎপাদন, মজুত ও বিক্রয়ের অভিযোগে দেশব্যাপী সাড়াশি অভিযান শুরু করেছিল পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক। নিষ্পাপ শিশুর খাদ্যেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। এতে স্বাস্থ্যগত ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষ। ঘটছে অপমৃত্যু। বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এমন অনিয়ম চললেও সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাঝে মধ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান চালানো হলেও কাজের কাছ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা এসব প্রতারকরা কিছুদিনের মধ্যে আবারও একই কাজে ফিরছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্য পণ্য, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, পশু খাদ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, শিশু খাদ্য, বেকারিপণ্য, খাবার পানি, প্রসাধনী থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সব কিছুতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। নামি দামি ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে নকল পণ্য। ভেজাল জ্বালানি তেলের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি। বিশ্বখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের চকলেট তৈরি হচ্ছে কেরাণীগঞ্জের জিনজিরা এলাকার টিনশেড ঘরে। তৈরি হচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন এর বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স, বিদেশি পাউডার, ড্রিঙ্কস জুস, চিপস, ডায়াপার সহ বিভিন্ন পণ্যের নকল। এ ছাড়া পোলট্রি ফার্মের ডিমে পাওয়া গেছে ট্যানারি বর্জ্যরে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, আম গাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক। শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশে অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে নকল-ভেজাল পণ্য উৎপাদনের কারখানা। মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যববহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রং, সোডা, স্যাকারিন ও মোম। কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হচ্ছে খাবারের মসলায়। ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে কার্বাইড, ইথোফেন আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব পণ্য কিনে প্রতিনিয়ত প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যান্সার, লিভার কিডনি বিকল হওয়া, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস সহ নানারোগের প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে ভেজাল খাদ্যকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
এটা সত্য, বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষকে নানাবিধ মরণব্যাধি থেকে রক্ষা করতে হলে খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দেশে ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উৎপাদন করেই হোক কিংবা আমদানি করেই হোক, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ এ দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। সেই সাংবিধানিক অধিকার সামনে রেখেই ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, উন্নত বিশ্বের ‘খাদ্য নিরাপত্তা’এর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রাখতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তাও খতিয়ে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে। দেশের জনগণকে নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই মনে রাখতে হবে, ভেজাল খাদ্য পণ্য জনস্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই প্রবণতা চলতেই থাকলে জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল করবে। এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যায় না। ভেজাল পণ্যও ভোক্তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় ও সুষ্ঠু জাতি গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নকল-ভেজাল বন্ধে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরও কড়া আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও পড়ুন
মন্তব্য করুন










