গণঅভ্যুত্থানের জুলাই সনদ

দেশের রাজনীতিতে ক্রমেই উত্তাপ বাড়ছে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ধরনের ঐক্য দেখা যেত, তা ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। গত বছর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার প্রধান দাবি ছিল ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন এবং তার আইনী রূপ দেওয়া।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদের’ খসড়া প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। খসড়াটি ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সফল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন বিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট করে। এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব সফল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশোর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় জনগণের মননে রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সহ-সভাপতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। পরবর্তীতে উক্ত কমিশন কিছুটা পুনর্গঠন করা হয়।
আরও পড়ুনকমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তি সমূহের সঙ্গে আলোচনা করা এবং এ মর্মে পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশ করা। কমিশনের মেয়াদ ছিল কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে ছয় মাস। কমিশন তার দায়িত্ববোধ ও সুপারিশের অংশ হিসেবে ঐকমত্যের মৌলিক বিষয় সম্বলিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জুলাই সনদ প্রণয়ন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং অনেক বিষয়ে একমত হতে পেরেছে।
বাকিগুলোও একমত হতে আলোচনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এদিকে জুলাই যোদ্ধারা ভীষণ চাপে রেখেছে সরকারকে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে জুলাই সনদের খসড়া’ প্রকাশ করেছে। যদিও এই খসড়ায় সব বিষয়ে সবার ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি এখনও। ছাত্রদের দাবি কিছু মৌলিক বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে খসড়ায় যা তারা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
অন্তর্বর্তী সরকারও বলছে, আরো আলোচনার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়াকে জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমরাও মনে করি জুলাই বিপ্লবের আশা-আকাক্সক্ষাকে ‘জুলাই সনদে’ আইনানুগ ভাবে ঠাঁই দেওয়া হোক। আমরা মনে করি, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ গড়ায় প্রত্যেককে মনোযোগ দিতে হবে, অবদান রাখতে হবে। এখন এটাই সবচেয়ে জরুরি।
মন্তব্য করুন