ভিডিও রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা কি এবং কীভাবে কাজ করে

স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা কি এবং কীভাবে কাজ করে, ছবি: সংগৃহীত।

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক:  প্রথিতযশা মার্কিন উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মস্তিষ্ক প্রসূত প্রযুক্তি সেবা “স্টারলিংক”। ছোট্ট এই শব্দটি সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অদেখা ভূবনের বার্তা দিয়ে চলেছে। চলমান দশকে ইন্টারনেট ব্যবস্থার মধ্যমণি হওয়ায় প্রযুক্তিগত বিবর্তনটিকে ঘিরে চলছে সমূহ উদ্দীপনা। অধিকাংশ উন্নত দেশগুলোতে বিস্তার লাভের পর উন্নয়নশীল অঞ্চল পরিক্রমায় স্টারলিংকের এবারের গন্তব্য বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটে চলুন জেনে নেওয়া যাক- কি এই স্টারলিংক, আর এর কার্যপদ্ধতিই বা কি।

স্টারলিংক কি

পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ চালু করা প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক সার্ভিসেস, এলএলসি। পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের নামানুসারেই উপগ্রহ ক্লাস্টারের নাম হয়েছে স্টারলিংক। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি এই স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। গোটা বিশ্ব জুড়ে ইলন মাস্কের এই প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক রয়েছে ১০০টিরও বেশি দেশে।স্টারলিংকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালের মে মাসে ৬০টি স্যাটেলাইটের চালুর মাধ্যমে। বর্তমানে এই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৭ হাজারেরও বেশি এবং এগুলো খুব কাছাকাছি কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এই অবস্থানটি প্রায় ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উপরে। এগুলো পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে (এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও) উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে সক্ষম।

২০২১ সালের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কেন্দ্রিক এর প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় প্রথম জনসাধারণের কাছ থেকে প্রি-অর্ডার নেওয়া হয়েছিল।

স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা কিভাবে কাজ করে

ইন্টারনেট সংযোগের প্রক্রিয়া

শহরাঞ্চলের পাশাপাশি অনুন্নত এলাকাগুলোতেও সমানভাবে কার্যকর স্টারলিংক পরিষেবা। স্টারলিংক গ্রাহকের কম্পিউটার বা অন্য কোনো ডিভাইস থেকে ডাটা রিকোয়েস্ট প্রথমে নিকটতম স্যাটেলাইটে পৌঁছায়। সেই রিকোয়েস্ট পরবর্তীতে প্রেরিত হয় উদ্দিষ্ট গন্তব্যের কাছাকাছি আরেকটি স্যাটেলাইটে। তারপর রিকোয়েস্টটি সেই স্যাটেলাইটের অধীনে থাকা সুনির্দিষ্ট ডাটা সার্ভারে প্রবেশ করে। এরপর কাঙ্ক্ষিত তথ্যটি নিয়ে একই ভাবে গ্রাহকের কম্পিউটার বা অন্য কোনো মোবাইল ডিভাইসে ফিরে আসে। এভাবে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা ডিভাইসের মধ্যে ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ রক্ষার্থে গেটওয়ে হিসেবে বসানো হয় গ্রাউন্ড স্টেশন। এগুলো উপগ্রহ থেকে ডেটা গ্রহণ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম রাখে। একটি গ্রাউন্ড স্টেশন সাধারণত ৪,৩০৬ বর্গফুট জায়গা জুড়ে প্রশস্ত হয়। এখানে বন্ধনীতে ঘেরা থাকে ৯.৪ ফুট উচ্চতার ৯টি অ্যান্টেনা।

উন্নত প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য

স্টারলিংকের প্রদক্ষিণরত উপগ্রহগুলোর অবস্থান আদর্শ জিওস্টেশনারি কক্ষপথের উচ্চতার ১/১০৫ থেকে ১/৩০ অংশের মধ্যে। কক্ষপথটি নন-জিওস্টেশনারি হিসেবে অভিহিত এবং এখানে স্যাটেলাইটগুলো ২৪ গিগা হার্টজ-এর উপরে উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করবে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলক ভাবে কাছাকাছি হওয়ায় এই ব্যান্ডে বিস্তৃত কভারেজ পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে স্যাটেলাইট ও গ্রাউন্ট স্টেশনের মধ্যকার যোগাযোগটিও হবে অধিক কার্যকর। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইট যোগাযোগের লেটেন্সি বা বিলম্ব থাকে প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ মিলি সেকেন্ড।  এই মাত্রা বর্তমান কেবল ও ফাইবার নেটওয়ার্কের তুলনায় অনেক কম। এই গতিতে ভিডিও কনফারেন্সিং ও অনলাইন গেমিং-এ অভূতপূর্ব রিয়েল-টাইম অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে।

পিয়ার-টু-পিয়ার প্রোটোকল ব্যবহার করায় স্টারলিংক বর্তমান সময়ের আইপিভি ৬ (ইন্টারনেট প্রোটোকল ভার্সন ৬) থেকে অধিক সহজ। এই প্রোটোকল মূলত ইন্টারনেটের আওতায় একত্রে কতগুলো ডিভাইস সংযুক্ত হতে পারবে এবং সেগুলোর মধ্যে তথ্যের লেনদেন কতটুকু নিরাপদ হবে তা নির্দেশ করে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নেটিভ এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন। এই প্রক্রিয়ায় প্রেরকের ডিভাইসে এনক্রিপ্ট করা ডাটা শুধুমাত্র প্রাপকের ডিভাইসে ডিক্রিপ্ট করা হয়। ফলে পরিষেবা প্রদানকারীসহ তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে সেই ডাটা উন্মুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। এই সর্বক্ষেত্রে পিয়ার-টু-পিয়ারের অবস্থান আইপিভি৬-এর ওপরে।

স্টারলিংক পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত ( এমন কি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ) উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে সক্ষম। ছবি: সংগৃহীত

আরও পড়ুন

এছাড়া স্টারলিংকের আরও আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে দ্রুতগতির ডাউনলোড। সম্প্রতি ঢাকায় এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে। এ সময় ডাউনলোড গতি ছিল ২৩০ এমবিপিএস (মেগাবিট্স পার সেকেন্ড) এবং আপলোড ২০ এমবিপিএস।সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী

স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য গ্রাহককে টেলিভিশনের ডিশ অ্যান্টেনার মতো একটি যন্ত্র বসাতে হবে। এটি সেই স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। যন্ত্রটি ক্রয়ের সময় এর সঙ্গে পুরো একটি টুলকিট দেওয়া হয়। এতে স্টারলিংক অ্যান্টেনা ছাড়াও থাকে স্ট্যান্ড, স্টারলিংক কেবল, জেন থ্রি রাউটার, এসি কেবল এবং পাওয়ার অ্যাডাপ্টার। অ্যান্টেনা যে কোনো জায়গায় মাউন্টের জন্য উপযোগী। এমনকি ট্রেনের মতো দ্রুতগামী কোনো বস্তুর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তবে শর্ত হচ্ছে- আকাশ ও অ্যান্টেনার মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা যাবে না।এই অ্যানটেনার সঙ্গে স্টারলিংকের রাউটারটি যুক্ত করে গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এই টুলকিট এবং গ্রাউন্ড স্টেশন সম্মিলিত ভাবে স্টারলিংককে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। কেননা এতে করে দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে।এই রাউটারে এক সঙ্গে ২৫৪টি ডিভাইস যুক্ত হতে পারে। অবশ্য কোম্পানির পক্ষ থেকে ৫০টির কম ডিভাইস ব্যবহারের পরামর্শ রয়েছে।

ইন্টারনেট পরিষেবার লাইসেন্স

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিংককে বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে সেবা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। সেখানকার জাতীয় টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষের অনুমতির পরেই সেবার বিপণন শুরু হয়। এর জন্য স্টারলিংক নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যায়। এই চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে লাইসেন্সিং-এর সাধারণ সময়সীমা এবং করনীতি।স্টারলিংক ব্যবহারের নানা ক্ষেত্র ।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্টারলিংককে সংশিষ্ট দেশের বিধি-নিষেধ , আেইন মেনে চলতে হয় । ছবি: সংগৃহীত ।

আবাসিক চাহিদার পাশাপাশি করপোরেট ক্লায়েন্টও রয়েছে স্টারলিংকের। ইতোমধ্যে তারা বিস্তৃত পরিসরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সেবা রয়েছে এয়ারলাইনস, জাহাজ, বিনোদনমূলক যানবাহন, ও ট্রাকসহ নানা ধরণের পরিবহনে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের মিলিটারি বা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট চাহিদার ভিত্তিতে তারা বিশেষ সেবা দিয়েছে।

ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা খরচের গড়পড়তা

স্টারলিংক ইন্টারনেট ফি প্রধানত অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। মূলত বিভিন্ন ব্যবহারকারীর চাহিদার সাপেক্ষে প্রস্তুতকৃত পরিষেবার খরচ নির্ধারণ করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য মাসিক ফি ৮০ থেকে ১২০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি ৯,৭২৬ থেকে ১৪,৫৮৯ টাকার (১ মার্কিন ডলার= ১২১.৫৭ বাংলাদেশি টাকা) সমতূল্য। রোমিং-এর ক্ষেত্রে এই খরচ ন্যূনতম ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬৫ ডলার (৬,০৭৯ থেকে ২০,০৬০ টাকা) পর্যন্ত। সরঞ্জামের খরচ শুরু হয় ৩৪৯ ডলার (৪২,৪২৯ টাকা) থেকে। করপোরেট গ্রাহকদের জন্য মাসিক ফি ৫০০ ডলার (৬০,৭৮৭ টাকা) এবং স্টারলিংক কিটের মূল্য ২,৫০০ ডলার (৩ লাখ ৩,৯৩২ টাকা)।

পরিশিষ্ট

ইলন মাস্কের ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমে এক অভাবনীয় সংযোজন। এর যুগান্তকারি ডাউনলোড ও আপলোড স্পিড এবং ডাটা লেটেন্সি আরও বেগবান করবে জীবনধারাকে। বিভিন্ন দেশে লাইসেন্সিং-এর বিধি-বিধানের সঙ্গে সমন্বয়ের আঙ্গিকে এই সেবাটি হতে পারে দেশের উন্নত অবকাঠামোর ভিত্তি-প্রস্তর। বিদ্যমান প্রযুক্তি থেকে অগ্রসরমান এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এক অপার সম্ভাবনার আলোকবর্তিকা। যেখানে রিয়েল-টাইম অ্যাপ্লিকেশনের দৌলতে বিশ্ব মানের বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হবে দেশীয় শিল্প।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুয়েটে ভিসির প্রতীকী চেয়ারে আগুন দিলেন শিক্ষার্থীরা

সিলেটে বেপরোয়া  ট্রাকের চাপায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

লক্ষ্মীপুরে ৪ জনপ্রতিনিধিসহ ৫ আ.লীগ নেতাকে আটক

প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের জন্য বড় সুখবর

জামায়াতে ইসলামী নয়, আজ আ’লীগই মানুষের অন্তর থেকে নিষিদ্ধ হয়েছে - ডা. শফিকুর রহমান

আমরা এখন ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করছি - রুহুল কবির রিজভী