সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি : বগুড়ার সারিয়াকান্দি কালিতলা নৌঘাটের সামনে চরবাটিয়ার যমুনা নদীতে এখন অবস্থান করা ভাসমান লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে মাত্র ২০ টাকায় নারীদের জরায়ু, হার্নিয়াসহ জটিল রোগের অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। এছাড়াও শুরু হয়েছে প্লাস্টিক সার্জারির মতো জটিল অপারেশন, পাচ্ছেন ফ্রী ওষুধ। প্রতিদিন শতশত রোগী ভিড় করছেন এই হাসপাতালে।
এমনই একজন ঝরনা বেগম (৩৫)। তিনি এসেছেন নারায়ণগঞ্জের আদমজী এলাকা থেকে। ছোটবেলায় একটি দুর্ঘটনায় তার শরীরের বাম পাশ আগুনে পুড়ে যায়। বেশকয়েক বছর চিকিৎসা করেও শরীরের তেমন একটা উন্নতি হয়নি। এক সময় তার শরীরের পোড়া অংশের সাথে বাম হাত জোড়া লেগে যায়। এক সময় তিনি তার ঘাড় নড়াচড়া করতে অক্ষম হলেও অভাবের কারণে উন্নত চিকিৎসা করতে পারেননি। সংবাদ পেয়ে তিনি এই হাসপাতালে এসেছিলেন।
ইতোমধ্যে মাত্র ২০ টাকায় তার শরীরে তিন দফায় অস্ত্রোপচার চালানো হয়েছে। ঝরনা বেগম জানান, তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ। কয়েকদিন আগে ঝরনা বেগমের ৩য় অস্ত্রপচার সম্পন্ন হয়েছে। তাকে রাখা হয়েছে চরের একটি টিনসেড ওয়ার্ড রুমে। এ রুমে ঝরনা বেগমের মতো আরও কয়েকজন রোগী বেডে শুয়ে আছেন। তারাও মাত্র ২০ টাকায় বিভিন্ন রোগের অপারেশন করেছেন।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ ভাসমান হাসপাতালে তাদের বিদেশি ডাক্তাররা অপারেশন করেছেন। এখন পর্যন্ত ৬৭৬টি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে। মানবসেবার ব্রত নিয়ে ২০ বছর আগে ২০০৩ সালে ইউনিলিভারের পণ্য লাইফবয় ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়।
ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালটি কয়েক মাস পরপর এক স্থান থেকে ছুটে চলে অন্য স্থানে। চরাঞ্চলের হতদরিদ্র ও নদীভাঙন কবলিত মানুষকে সেবা দিতে প্রায় ১২০ কিলোমিটার নদীপথ ঘুরে ঘুরে নতুন এলাকায় নোঙর করে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৯২৯ জন রোগীকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার ২৮৪ জন রোগীকে এবং মাধ্যমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৪ জন রোগীকে। এছাড়াও ৪৫ হাজার ৮০৯টি বিশেষায়িত পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এ হাসপাতালের অধীনে ১৭ হাজার ৫১৮টি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এর মধ্যে চোখের ১০ হাজার ৪৯১টি, দাঁতের তিন হাজার ২১৮টি, অর্থোপেডিক্স ৮৫৯টি, পেডিয়াট্রিক্স ৬৭৩টি, ৩৫১টি গাইনি এবং রিকন্সট্রাক্টিভ বা প্লাস্টিক সার্জারি ৬৭৬টি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে।
বহির্বিভাগের পাশাপাশি এ হাসপাতালে ২৩৫টি জাতীয় এবং ২০৬টি আন্তর্জাতিক মেডিকেল টিম ৪৪১টি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প পরিচালনা করেছে। হাসপাতালের মূল গেটেই রয়েছে রোগীদের নিবন্ধন কক্ষ। যেখানে রোগীরা ২০ টাকায় নিবন্ধন করে একটি আইডি কার্ড পান।
এ আইডিকার্ড অনুযায়ী বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে বিশেষায়িত পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধ পান রোগীরা। প্রয়োজন অনুযায়ী বিনামূল্যে রোগীদের বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাও করা হয়। দাঁতের সমস্যায় রোগীদের জন্য রয়েছে সুসজ্জিত ডেন্টাল কক্ষ, রয়েছে অত্যাধুনিক ইসিজি, এক্সরে এবং আল্ট্রাসাউন্ডসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। হাসপাতালের একদিকে রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার। ভাসমান এ হাসপাতালের নিচের তলায় স্টাফদের বিশ্রামাগার।
নদীপাড়ের খোলা জায়গায় টিনের বেড়া আর ছাউনির অস্থায়ী ক্যাম্পে নারী ও পুরুষেরা থাকেন পৃথকভাবে। অস্ত্রোপচারের পর রোগীরা এখানে থাকেন প্রয়োজন অনুযায়ী। এখানে অসহায়দের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হয়। জাহাজের পেছনে বাঁধা চরাঞ্চল থেকে রোগী পরিবহনে দু’টি নৌ অ্যাম্বুলেন্স ও রোগীদের পৌঁছে দিতে দু’টি ট্রলার রয়েছে। হাসপাতালে বিনামূল্যে প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মাতৃত্বজনিত সেবা, শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা, দাঁতের চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, এক্স-রে, ইসিজিসহ সব ধরণের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়।
এছাড়া ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা, পোড়া রোগী, হাত-পা বাঁকা (অর্থোপেডিক সার্জারি), হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, টিউমার ও চোখের ছানির মতো জরুরি অস্ত্রোপচারও করা হয়। হাসপাতালের ডাক্তার শফিউল আজম বলেন, সুবিধাবঞ্চিত চরাঞ্চলবাসীরা নানাভাবে ভাত-কাপড়ের অভাবটা মোচন করেন। কিন্তু উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে তারা একেবারেই বঞ্চিত।
কারণ দুর্গম চরাঞ্চল থেকে হাসপাতালের দূরত্ব অনেক বেশি এবং চরে ভালো কোনও রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারও পাওয়া যায় না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা গ্রামের অপচিকিৎসার শিকার হন। তাদের উন্নত চিকিৎসা দিতে ভাসমান হাসপাতালে কয়েক দশক ধরে বিনামূল্যে এ চিকিৎসাসেবা চলমান রয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।