ভিডিও শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:৩৯ দুপুর

আরেকবার উঠে দাঁড়ান, বেগম খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতির বিস্তৃত আকাশে কিছু নাম নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, ইতিহাসের ধারা বারবার ঘুরে যায় তবু কিছু নাম মুছে যায় না। বেগম খালেদা জিয়া ঠিক এমনই একটি নাম যা জাগায় আশা, জাগায় প্রেম-ঘৃণার ভিন্ন অনুভূতি, কিন্তু সবশেষে এক অনিবার্য বাস্তবতা এনে দেয়: বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস তাঁকে ছাড়া পূর্ণ হয় না। আজ তিনি প্রায় নিঃশব্দ, প্রায় নিশ্চল। রাজনৈতিক উত্তাপের মাঠ থেকে বহু দূরে, হাসপাতালের সাদা দেওয়ালের ভেতর বন্দি একটি সহনশীল ইতিহাস। কিন্তু এমন মুহূর্তেই মানবিকতার গভীর আলোয় তাঁর দিকে তাকিয়ে বলার ইচ্ছে জাগে উঠে দাঁড়ান, বেগম জিয়া। আরেকবার। ইতিহাসের করিডোরে বেগম খালেদা জিয়ার পদচারণা ছিলো উজ্জ্বল ও দীপ্তিময়। তবে বেগম জিয়ার রাজনীতিতে আগমন ছিল না কোনো প্রস্তুত পরিকল্পনার ফল। এ ছিল ভাগ্যের নির্মম আহ্বানে পাওয়া এক দায়িত্ব। রাজনৈতিক পান্ডিত্য, বক্তৃতার মহিমা, তাত্ত্বিক জ্ঞান কোনোটাই তখন তাঁর পরিচয়ের অংশ ছিল না। তবু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর সামরিক অস্থিরতার ভয়ানক সময়ে এক নারীর ওপর চাপানো হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভার। এ এমন সময়, যখন আত্মীয় হারানো এক তরুণী বিধবার শোকে জীবন স্তব্ধ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তিনি স্তব্ধ হননি। রক্তাক্ত শোককে তিনি পরিণত করেন দায়িত্বের নতুন রূপে নিজের না, রাষ্ট্রের, জনগণের, গণতন্ত্রের প্রতি। এই রূপান্তর সহজ ছিল না। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে জাতীয় নেত্রী যাত্রাটা ছিল বন্ধুর পথ, কাঁটায় ভরা, অবিশ্বাসে ঘেরা। কিন্তু সময়ই তাঁর শিক্ষক; দায়িত্বই ছিল তাঁর প্রশিক্ষণ। ব্যক্তির ভেতরে লুকানো পাহাড়সম শক্তি যে শক্তির নাম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছিল নিত্যসঙ্গী। তার ভেতর উঠে দাঁড়ানো একজন নারীর গল্প এ গল্প কেবল রাজনীতির নয়; এ গল্প সাহসের। কর্তৃত্বের ঘরানা ভেঙে তাঁকে সামনে আসতে হয়েছে শত উপহাস, অপবাদ, রাজনৈতিক আক্রমণ মোকাবিলা করে। কারাবাস, গৃহবন্দিত্ব, হুমকি, দলীয় বিভাজন, রাষ্ট্রক্ষমতার বিরোধিতা সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক চলমান ঝড়ের মধ্যে। তারপরও তিনি কখনো কণ্ঠস্বর হারাননি; কখনো মাথা নত করেননি। তিনি জানতেন, তাঁর ওপরে কেবল পরিবারের নয়, একটি রাজনৈতিক যাত্রার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এ দৃঢ়তা ছিল ব্যক্তিমানুষের ভেতরে লুকানো পাহাড়সম শক্তি। এ শক্তির দীপ্তি আজও তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের চোখে জ্বলজ্বল করে। রাজনীতির বাইরে বেগম জিয়ার জীবনে যে শোক, যে নিঃসঙ্গতা, যে আঘাত তা যেকোনো মানুষকে ভেঙে দিতে পারত। ভাইয়ের অকাল মৃত্যু, সন্তানের মৃত্যু, স্বামীর হত্যা, দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতা সব কিছু নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই কঠিন। তবু তিনি ভাঙেননি। অভিযোগ করেননি ইতিহাসের কাছে; বদলা নিতে চাননি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এই মানবিক শক্তি, এই নীরব সহ্যক্ষমতা তাঁকে রাজনীতির বাইরে একজন মহীয়সী নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গণতন্ত্রের যাত্রায় তাঁর অবদান অপরিসীম। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। সেই আন্দোলনে বেগম জিয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। দল, মত, মতাদর্শ পেরিয়ে তিনি সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চে এসেছিলেন যাতে একটি প্রজন্ম ভোটাধিকার, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নাগরিক মর্যাদা ফিরে পায়। এ দৃশ্য ছিল বিরল। এ দৃশ্য আমাদের দেখিয়েছে, জাতীয় স্বার্থে নেতৃত্ব কেমন উদার হতে পারে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করেছেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্তার ঘটিয়েছেন, রপ্তানি বাণিজ্য ও গার্মেন্টস খাতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে নতুন প্রণোদনা দিয়েছেন, স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সূচনা করেছেন। অবশ্যই রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল, ত্রুটি ছিল, সমালোচনা ছিল কিন্তু তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করে বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে আসত না। আজকের বেগম জিয়া আগের মতো আওয়াজ তোলেন না। তার চোখে আগুন নেই, আছে গভীর নীরবতা। তাঁর হাতে মাইক নেই, আছে স্যালাইনের সূচ। একসময়ের প্রবলমতি নেত্রী আজ শয্যাশায়ী, দুর্বল, চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। রাত-বিরাতে হাসপাতালের কক্ষে তাঁর নিঃশ্বাসের ওঠানামা যেন এক ইতিহাসের প্রবাহকেই থমকে দেয়। প্রশ্ন জাগে যে নারী সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, যিনি কখনো হার মানেননি, তাকে কি এভাবে একা, অসহায়, রোগশয্যায় দেখে আমাদের বিবেক শান্ত থাকে? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় তিনি আজ একজন মানুষ। মানবিকতার কাছে রাজনীতি তুচ্ছ। একজন অসুস্থ প্রবীণ নারীকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, কৌশল, মহড়ার মধ্যে আটকে রাখা সভ্যতার কাজ নয়। জাতির মহান নেতৃবৃন্দদের আমরা সব সময়ই দেখেছি, রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলেও মানবিক মর্যাদায় তাঁরাই সবার আগে এগিয়ে এসেছে। আজ খালেদা জিয়ার প্রতি সেই একই মানবিক আচরণ দেখানো আমাদের দায়িত্ব। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিপক্ষ সবার জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজনটা একটাই: তাঁর জীবন রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করা। তিনি কি আবার উঠতে পারবেন? ইতিহাস বলে: হ্যাঁ, পারবেন ইনশাআল্লাহ। রাজনীতি হয়তো তাঁর শরীরের কাছে আর দাবি রাখে না। কিন্তু জীবন তাকে এখনো ডাকে। যে নারী বারবার ভেঙে পড়ে আবার দাঁড়িয়েছেন-রক্তাক্ত রাজপথ থেকে, অপবাদ থেকে, কারাবাস থেকে, নিষেধাজ্ঞা থেকে, রাজনৈতিক হিংসা থেকে তিনি কি আবার উঠতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। এ উঠা হয়তো রাজনীতির মাঠে নয়, কিন্তু মানবিক মর্যাদার, শারীরিক সুস্থতার, জীবনের আলো ফিরিয়ে পাওয়ার পথে হবে। মানবিকতার আলোয় দাঁড়িয়ে একটি জাতির প্রার্থনা আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে। আমরা আজ তাঁকে দেখি: সাদা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা এক দৃঢ়চেতা নারীকে, রাজনীতির ঝড় পেরিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া শরীরকে, কিন্তু অটুট এক মনোবলকে। এই দৃশ্য রাজনৈতিক শ্লোগান জাগায় না; এ দৃশ্য জাগায় মানবিক দায়বোধ। এ কারণেই আমরা বলি, বেগম জিয়া, আপনি আরেকবার উঠুন।আপনার হাত শক্ত হয়ে উঠুক, চোখে ফিরে আসুক আলো, মুখে ফিরুক সেই স্থিরতা, যা একসময় লক্ষ মানুষকে সাহস দিত। ইতিহাস আপনাকে ভুলবে না, কিন্তু আমরা চাই, আপনি নিজেই ইতিহাসের পরবর্তী পাতাগুলো দেখুন- সুস্থভাবে, মর্যাদার সঙ্গে, জীবনকে নতুন করে ধারণ করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এক প্রতীক দৃঢ়তার, সহনশীলতার, সংগ্রামের, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে টিকে থাকার। আজ তাঁর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনীতি নয়, মানবিক সহমর্মিতা। সেই সহমর্মিতার জায়গা থেকেই এই প্রার্থনা আরেকবার উঠে দাঁড়ান, বেগম খালেদা জিয়া। জাতি চান আপনি সুস্থ হন। ইতিহাস চায় আপনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন। মানবিকতা চায় আপনি জীবনের দিকে ফিরে তাকান নব আলোয়।

লেখক

প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী

আরও পড়ুন

উপাচার্য 
নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আরেকবার উঠে দাঁড়ান, বেগম খালেদা জিয়া

গণতান্ত্রিক শক্তিক ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান তারেক রহমান

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলি, নিহত ৪

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস বিস্ফোরণ, একই পরিবারের ৪ জন দগ্ধ

চট্টগ্রামে বিয়ে প্রস্তুতির বৈঠকে ছুরিকাঘাতে নিহত ১

আজ সিলেটে জামায়াতসহ ৮ দলের বিভাগীয় সমাবেশ