স্বাস্থ্যসেবার নামে অতিরিক্ত পরীক্ষায় ভোগান্তি
স্বাস্থ্যই সম্পদ এই কথাটি আমরা সবাই জানি। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আধুনিক চিকিৎসাসেবা, দক্ষ চিকিৎসক এবং উন্নত ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তি আজ হাতের নাগালে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাধারণ মানুষ এখন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গেলে ভয় পান। কারণ তাঁদের মুখে একটাই কথা “হাসপাতালে গেলেই একের পর এক টেস্ট ধরিয়ে দেয়, এত টাকা আমরা কোথায় পাবো?” এই উদ্বেগই আজ আমাদের দেশের রোগ নির্ণয়ব্যবস্থা ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
জ্বর, সর্দি, কাশি এসব খুব সাধারণ অসুখ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসজনিত। কয়েকদিন বিশ্রাম আর কিছু ওষুধেই সেরে যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রোগী জ্বর নিয়ে হাসপাতালে গেলে শুনতে হয় টেস্টের নামের তালিকা সিবিসি, ইএসআর, সিআরপি, ইউরিন টেস্ট, ডেংগু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড যেন জ্বরের প্রত্যেকটি সম্ভাবনা একবারে যাচাই না করলে চিকিৎসা শুরুই করা যাবে না। যেসব ক্ষেত্রে ডাক্তার উপসর্গ শুনে সামান্য ব্যথানাশক বা জ্বরের ওষুধ দিলে সমস্যা কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যেতে পারত, সেখানে পরীক্ষা করতেই খরচ ২০০০-৩০০০ টাকা। বুক ব্যথার ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা। বেশিরভাগ সময় গ্যাস্ট্রিকের জন্য বুক ভারী লাগে, যা সাধারণ ওষুধে সেরে যেতে পারে। কিন্তু রোগীকে দেওয়া হয় ইসিজি, সিবিসি, এইচপাইলরি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এমনকি এন্ডোস্কোপিও। এই সব মিলিয়ে খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৪০০০-৫০০০ হাজার টাকার মতো। অথচ একটি সাধারণ অ্যান্টাসিড বা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধই অনেক সময় যথেষ্ট।
একজন দিনমজুর বা শ্রমজীবী মানুষ যার পরিবারের মোট মাসিক আয় ১২-১৫ হাজার টাকা, একবার হাসপাতালে গিয়েই যদি তার ৩-৪ হাজার টাকার মতো খরচ করতে হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা হাসপাতালের দরজা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। তখন ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই ফার্মেসির স্বল্প মূল্যের ওষুধ কিনে দিনের পর দিন খেতে থাকেন। যদি সাধারণ জ্বর-কাশি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়, তবে হয়তো সাময়িক উপশম মেলে। কিন্তু যদি সমস্যাটি গুরুতর হয়, তবে মারাত্মক রোগটি নীরবে শরীরে বড় হতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ফার্মেসি থেকে কিনে খাওয়া যত্রতত্র ওষুধ সেবনের কারণে তাদের কিডনি ও লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ওপর চাপ পড়ে। ফলাফলস্বরূপ, সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে তারা আরও জটিল শারীরিক কষ্টের শিকার হন।
প্রশ্ন হলো, কেন এমনটি হচ্ছে? সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো, কিছু চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রোগী পাঠানোর জন্য কমিশন বা পার্সেন্টেজ পেয়ে থাকে। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা লেখার এটি একটি প্রধান কারণ। পরীক্ষা যত বেশি হবে, কমিশনের পরিমাণও তত বাড়বে। কিছু বিশেষ পরীক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসককে দেওয়া কমিশনের হার ২৫% থেকে ৪০% পর্যন্ত হতে পারে। আবার, দামি যন্ত্রপাতি কিনে প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু বড় বিনিয়োগ করে, তাই যন্ত্রের ‘ফুল ইউটিলাইজেশন’ নিশ্চিত করার চাপও থাকে। ফলে অনেক সেন্টার পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে আয়ের পথ খোঁজে। তবে এ কথাও সত্য সব চিকিৎসকই অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা লেখেন না। অনেক ডাক্তারই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন। তাঁরা বলেন সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য কখনো কখনো একাধিক পরীক্ষা করা জরুরি হয়। একই উপসর্গে বিভিন্ন রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। ভুল নির্ণয় রোগীর জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই কখনো ‘সতর্কতা’ হিসেবে কিছু পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে মূলত চিকিৎসকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব, রোগী ও স্বজনদের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে দেখা যায়। এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর তদারকি, স্বচ্ছ সেবা এবং চিকিৎসকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা। সরকারের উচিত শক্ত নীতিমালা তৈরি এবং কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করা। কোন উপসর্গে কোন টেস্ট প্রয়োজন এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর পরীক্ষা ফি, প্যাকেজ মূল্য ও অতিরিক্ত চার্জ সব প্রকাশ্য করতে হবে। পাশাপাশি, সরকারি হাসপাতালগুলোর মানোন্নয়ন করা আবশ্যক। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, দক্ষ স্টাফ এবং দ্রুত রিপোর্ট দেওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করলে রোগীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট সেন্টারের দিকে ছুটবে না।
চিকিৎসকদের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারই রোগীর প্রথম ভরসা। তিনি চাইলে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বন্ধ করতে পারেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলে, উপসর্গ বুঝে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব তাঁরই। রোগীকেও সচেতন হতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে। জানতে হবে, কোন পরীক্ষা কেন প্রয়োজন। রোগী যদি নিজের অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকে, তাহলে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার জায়গা কমে যাবে। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। এখানে ব্যবসা থাকতে পারে, কিন্তু নৈতিকতা ও মানবিকতা উপেক্ষা করে নয়।
আরও পড়ুনলেখক
ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








