ভিডিও বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৪০ দুপুর

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস

আজ ৩রা ডিসেম্বর ৩৪তম আন্তর্জাতিক ও ২৭তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য “অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিকশিত নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে প্রতিবন্ধী জনগণ"। যথাযথ মর্যাদার সাথে গোটা বিশ্বে ও জাতীয় পর্যায়ে উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে আজকের এই দিবসটি। প্রতিবন্ধী শব্দটার মাঝে রয়েছে দয়া, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আবেগ মিশ্রিত ভিন্নমাত্রার এক অনুভূতি। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি এই মানুষের মাঝেই রয়েছে  এমন কিছু মানুষ যারা শারিরীক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয় এই মাটির ধরণীতে। যাদেরকে প্রতিবন্ধী শব্দ নামক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়ে থাকে। প্রতিবন্ধী শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে যারা আপনার আমার মতন স্বাভাবিক নয় তাদেরকেই প্রতিবন্ধী বলা হয়ে থাকে। এর পেছনে সচরাচর দুটি কারণ থাকে প্রথমত জন্মগতভাবে দ্বিতীয়ত দুর্ঘটনাজনিত কারণে। প্রতিবন্ধী বিভিন্ন প্রকারের যেমন........* দৈহিক /শারিরীক প্রতিবন্ধী /* দৃষ্টি প্রতিবন্ধী /* শ্রবণ প্রতিবন্ধী ( যারা শুনতে পায় না) /* বাক প্রতিবন্ধী /* বুদ্ধি প্রতিবন্ধী /* বহুবিধ প্রতিবন্ধী। /বহুবিধ প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অটিজম, সেরিব্রাল পলিসি, ডাউন সিনড্রোম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

দীর্ঘদিন ধরে উন্নত দেশগুলিতে এইসব বিষয়ে অনেক গবেষণা, সাহায্য সহযোগিতা সহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু আছে। আমাদের দেশে এই বিষয়গুলো একেবারেই অবহেলিত ছিলো বলেই সমাজে প্রচলন ছিলো নানান কুসংস্কার। যেমন জীন পরীর আছর, পাপের ফসল, পাগল, অভিশাপ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা হতো। বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগে আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার কারণে প্রতিবন্ধীদের কে নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই অনাগ্রহ ভাব দেখিয়ে ভাববার পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে বেশ কয়েকবছর যাবৎ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমুহে প্রতিবন্ধীদের কে নিয়ে গবেষণা, তাদের জন্য নানারকমের সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসা, স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাদের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারিভাবে বিশেষকরে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তালিকা তৈরি করে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রতি মাসে ৮৫০ টাকা যা তিনমাস অন্তর প্রদান করা হয়ে থাকে। ভাতা না পেলেও এদের সকলকে একটি করে কার্ড দেওয়া হয়, যাকে “ সুবর্ণ নাগরিক কার্ড “ বলা হয়।  বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের কে বৃত্তি প্রদান করে সমাজসেবা অধিদপ্তর, বৃত্তির পরিমাণ প্রতিমাসে ৯৫০ টাকা এটাও তিনমাস অন্তর প্রদান করা হয়। শারিরীক প্রতিবন্ধী হলেও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থদেরকে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে উপার্জনমুখী করে তোলা হয়। এছাড়াও নিউরো ডেপলপমেন্টাল ডিজাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাষ্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদেরকে এককালীন অনুদান কিংবা ঋণ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর এর মাধ্যমে রেজিস্ট্রারভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই স্বল্প সুদে প্রদান করে থাকে। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নামক আরো একটি প্রতিষ্ঠান এদের উন্নয়নে নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি জেলা ও বেশ কয়েকটি উপজেলায় এপর্যন্ত সর্বমোট ১০৩ টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র নামে আরো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ওদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা, সবধরনের থেরাপির ব্যবস্থাসহ আরো কিছু উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চিকিৎসা সেবা ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় হুইলচেয়ার, ক্রাচ, শ্রবন প্রতিবন্ধীদের জন্য কানে শোনার মেশিন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সহায়ক সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিশু বিকাশ কেন্দ্র নামে এদের জন্য উন্নত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোঠা এমনকি চাকুরির ক্ষেত্রেও এই কোঠা পদ্ধতি ওদের মনে আশার আলো সঞ্চার করে। এতো এতো আয়োজন ও সুব্যবস্থা যাদের জন্য তাদের বেশীরভাগেরই জানা নেই এইসব প্রতিষ্ঠান ও সুযোগ সুবিধার কথা। পাশাপাশি নির্মম হলেও সত্য প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এইসব সাহায্য সহযোগিতা। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের জন্য যে সাহায্য দেওয়া হয়ে থাকে সেখানেও যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অবলোকন করা হয় তবে যথেষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র খুব সহজেই বোঝা যায়। একজন প্রতিবন্ধী আসলেই সে প্রতিবন্ধী কিনা সেটা প্রমাণ করা এদের অভিভাবকদের জন্য বিশাল এক অগ্নিপরীক্ষা। সার্বিক বিবেচনায় বলতে গেলে প্রতিবন্ধীদের মাঝে শ্রেণীবিন্যাস করা অতি প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল এবং সব বয়সের প্রতিবন্ধীদের প্রতি শতভাগ সম্মান রেখে বলতেই হয় প্রকৃত অর্থে উপরে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান থেকে বেশীরভাগ যারা সাহায্য পায় তারা কমবেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী কিন্তু তারা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। সাহায্য-সহযোগিতা না পেলেও তারা যে কোনো কর্ম করে জীবনধারণ করার সামর্থ রাখে। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা বাস্তবিক অর্থে স্বাভাবিক মনে হলেও, নিজের পরিচর্যা এমনকি ন্যূনতম স্বাভাবিক জীবনযাপন তাদের জন্য কল্পনাতীত ব্যাপার। তবে কিছুকিছু অটিজম আক্রান্তরা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অনন্য প্রতিভার অধিকারী হয়ে থাকে, যা গভীরভাবে অন্বেষণ করে খুঁজে বের করতে হবে। এমন প্রতিভা সম্পন্ন অনেকেই আছেন যারা সমগ্র পৃথিবীতে অমর হয়ে রয়েছেন। সেরিব্রাল পলিসি ও ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অস্বাভাবিক হলেও সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যার ফলে অনেকক্ষেত্রেই কিছুটা হলেও সফলতা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সেরিব্রাল পলিসি  আক্রান্ত বাচ্চারা সফলতার ক্ষেত্রে একটু হলেও এগিয়ে আছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে মোটেও স্বাভাবিক নয় তাদের কিংবা এদের অভিভাবকদের ভাতা সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য যে কাগজপত্র তৈরী করতে হয় সেগুলো তৈরি করতে নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় বিধায় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হতে হয়। যেহেতু এদের বেশীরভাগই কোনো কর্ম করতে পারে না তাই সাহায্য ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে এদের অগ্রাধিকার বেশী দেওয়া প্রয়োজন কিন্তু তা কখনোই দেওয়া হয় না। প্রতিবন্ধীদের জন্য এতো সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্¡েও প্রচারের অভাব, যথাযথ কর্তৃপক্ষের শহর থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের অনগ্রসর  অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের এই সেবামূলক বার্তা পৌঁছাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই আজও তৈরি হয়নি প্রতিবন্ধীদের সঠিক তালিকা, অনেকেই পায়নি সুবর্ণ নাগরিক কার্ড কিংবা ন্যূনতম কোনো ভাতা সাহায্য সহযোগিতা। 

এবার একটু অন্য প্রসংগে আসি সেটা হলো অটিজম,  সেরিব্রাল পলিসি ও ডাউন সিনড্রোম শিশুদের জন্য প্রতি জেলা ও উপজেলায় এম.পি.ও ভুক্ত একটি করে স্কুল তৈরির সিদ্ধান্ত বিগত সরকারের সময়  সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো এক আলোচনা সভায় শুধু  আলোচনায় এসেছিল। আর এই সুযোগে সমাজের কিছু সরকারদলীয় নেতা ও সুযোগ সন্ধানী টাউট বাটপাররা রাতারাতি নানা নামে প্রতিবন্ধী স্কুল খোলার প্রতিযোগিতায় নেমে পরে। ন্যূনতম অভিজ্ঞতা থাকুক আর না থাকুক শুরু হয়ে যায় সেই স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের নামে বিশাল নিয়োগ বাণিজ্য। এই প্রতিযোগিতা শুধু জেলা ও উপজেলায় নয় একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ে দুই তিনটি করে স্কুলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নামমাত্র ছাত্রছাত্রীদের তালিকা তৈরী করে যাত্রা শুরু হতে লাগলো প্রতিবন্ধী স্কুলের। পাশাপাশি প্রচার করা হলো অচিরেই এই স্কুল এম.পি.ও ভুক্ত হয়ে যাবে, আর এই কাজে এই স্কুলের সুনাম অনেক এগিয়ে আছে, উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ কথা দিয়েছে ইত্যাদি। অতএব যে আগে আসবে সে আগে চাকরির সুযোগ পাবে কিন্তু এই কাজ করতে লাগবে অনেক টাকা। এখানেই শুরু হলো নিয়োগ নামের বিশাল অংকের বাণিজ্যের খেলা। স্কুল প্রতিষ্ঠাতার নিজের কিংবা নামমাত্র দামে সামান্য একটু জায়গা ক্রয় করে কোনোরকমে দুইএকটা ঘর নির্মাণ করে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা উদ্বোধন করে ছাত্রছাত্রী বিহীন প্রতিবন্ধী স্কুলের কার্যক্রম শুরু করে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে যায় কিন্তু আজও হয়নি স্কুলের অনুমোদন কিংবা এম.পি.ও ভুক্তকরণ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও রাজধানীর বুকে আন্দোলনে নেমেছিল কিন্তু কিছুই জোটেনি ভাগ্যে। চাকুরী নামক সোনার হরিণ ধরার আশায় আশান্বিত হয়ে শিক্ষকগণ বিনাবেতনে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আজ তারা আশাহত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকেই দিচ্ছে ধিক্কার। প্রতারকের প্রলোভনে প্রভাবিত হয়ে নিজের কষ্টের জমানো টাকা খোয়া যাওয়ার জন্য।

প্রতিবন্ধীদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আমাদের সমাজের কিছু সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। অসুস্থ ও অসহায় এই মানুষগুলোকে সামনে রেখে এদের উন্নয়নের নামে চলছে দূর্নীতির মহোৎসব, সেবার নাম ভাঙিয়ে অর্থ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। ভুলে গেলে চলবে না যে এরা প্রতিবন্ধী কিন্তু প্রতিভাবন্ধী নয়, এরা আমাদের সমাজেরই অংশ, আমাদেরই সন্তান অথবা ভাইবোন। দয়া, অবহেলা, করুণার চোখে নয় বরং বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গের এগিয়ে এসে প্রতিবন্ধীদের সেবা, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অগ্রযাত্রাকে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আরো ত্বরান্বিত করতে হবে। দেশের সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসে মুখরিত হোক সবার কন্ঠে বিকশিত নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে প্রতিবন্ধী জনগণ।  

লেখক 

শাব্বীর পল্লব 

প্রাবন্ধিক ও গবেষক 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস

বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতার লিভ টু আপিলের আদেশ

গুমের বিচারে নতুন অধ্যাদেশ নিয়ে যা জানালেন চিফ প্রসিকিউটর

বেগম জিয়ার অসুস্থতা শেখ হাসিনার কারণে: রিজভী 

আমরা নির্বাচনের জোয়ারে আছি, শতাব্দীর ভালো নির্বাচন চাই: ইসি সচিব

ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাদুরো