দুর্নীতির যাঁতাকলে জাতি আর কতদিন
বর্তমানে আমাদের সমাজে সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ সমস্যা হলো দুর্নীতি। এটি এমন এক ব্যাধি, যা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির নৈতিক ভিত্তিকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সহজ ভাষায় দুর্নীতি হলো নীতি-নৈতিকতা, সততা ও আইনের পরিপন্থী যে কোনো কাজ, যার মাধ্যমে কেউ নিজের বা অন্যের অনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করে। ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, মিথ্যা তথ্য প্রদান, খাদ্যে ভেজাল মেশানো সবই দুর্নীতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
বাংলাদেশে দুর্নীতি আজ একটি গভীরভাবে প্রোথিত সমস্যা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) এর প্রতিবেদনে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছিল। যদিও সময়ের সঙ্গে কিছু পরিবর্তন এসেছে, তবু বাস্তবচিত্র বলছে দুর্নীতি এখনো আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে আছে। নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সব জায়গায় দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। একজন সাধারণ নাগরিক যখন বাজারে যায়, তখন ন্যায্যমূল্যে ভালো পণ্য পায় না; অতিরিক্ত দাম দিয়েও নিম্নমানের বা ভেজাল পণ্য পেতে হয়। একটি সাধারণ জন্মনিবন্ধন বা জমির খতিয়ান করতে গেলেও “দ্রুত কাজ” করানোর জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। পুলিশ যদি কোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু সেই আসামি টাকা দিয়ে মুক্তি পায় তাহলেই বোঝা যায়, দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে পৌঁছেছে। এমনকি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিও অর্থের জোরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় এ যেন ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবমাননা।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও চিত্র ভিন্ন নয়। হাসপাতালে দেখা যায়, যে বেশি টাকা দিতে সক্ষম, সে আগে চিকিৎসা পায়; দরিদ্র রোগী অপেক্ষা করতে থাকে কষ্টে। শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রেও দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যোগ্য প্রার্থী চাকরি পায় না, কারণ তার হাতে ঘুষ দেওয়ার মতো অর্থ নেই। ফলে অযোগ্যরা দায়িত্বে বসে সমাজ ও প্রশাসনের ভিত দুর্বল করে দেয়। এভাবেই এক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, যারা নিজেরাও ঘুষ নিয়ে কাজ করে এবং অন্যদের একই পথে টেনে নিচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে দুর্নীতি করে কারা? এর উত্তর সহজ আমরা নিজেরাই। আমাদের মধ্যে যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়, তারা মনে করে, “আমি ঘুষ দিয়েছি, এখন এই টাকা যেভাবেই হোক তুলতে হবে।” ফলে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তারা নিজেরাই পরবর্তীতে দুর্নীতির খেলায় অংশ নেয়। সাধারণ জনগণও সুযোগ পেলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। কেউ যদি বলে, “দেশে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না” তাহলে সে নিজেই দুর্নীতিকে স্বাভাবিক করে তুলছে। আমরা একদিকে দুর্নীতির সমালোচনা করি, আবার অন্যদিকে একই কাজে অংশ নিই। এই দ্বিচারিতা সমাজকে ধ্বংস করছে। আমরা বুঝতে পারছি না দুর্নীতির মাধ্যমে আমরা কেবল অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছি না, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তিও নষ্ট করছি। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব, দায়িত্ববোধ ও লজ্জাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে আইন আছে, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ সীমিত। আইন থাকলেও যখন তার প্রয়োগ হয় না, তখন মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। নাগরিকের সেই হতাশাই আবার দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তোলে।
তাহলে দুর্নীতির শেষ কোথায়? দুর্নীতি শেষ হবে না কোনো আইনের জোরে একদিনে; এটি শেষ করতে হবে নৈতিকতা ও সচেতনতার মাধ্যমে। এছাড়াও দুর্নীতি সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দন্ডবিধি মোতাবেক অপরাধসমূহের শাস্তি এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীনে ঘুষ এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত অপরাধ যার শাস্তি অন্যূন ৪ (চার) বৎসর এবং অনধিক ১২ (বার) বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুন মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড ইত্যাদি শাস্তি বিচার বিভাগকে তা নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে ধর্মীয় অনুশাসনও পারে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে। যদি প্রতিটি পরিবার তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ, সততা, অন্যের অধিকার সম্মান করা, মিথ্যা না বলা, ঘুষ না নেওয়া এবং অন্যের সম্পদে লোভ না করা শেখায় তাহলে সমাজে নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শুধু পুঁথিগত জ্ঞান নয়, শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই হবে মূল লক্ষ্য। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা ছড়াতে হবে, যেন মানুষ অনৈতিক কাজের ফল সম্পর্কে জানে এবং ভয় পায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সততা। নিজের অবস্থান থেকে সৎ থাকা, ঘুষ না দেওয়া, কারও অধিকার লঙ্ঘন না করা। প্রত্যেকে যদি নিজের অবস্থান থেকে সৎ থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে সমাজ পরিবর্তিত হবে। আমাদেরই হাতে দেশকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। দুর্নীতি কোনো অভিশাপ নয়, এটি মানুষ সৃষ্ট সমস্যা আর মানুষই এর সমাধান করতে পারে।
আরও পড়ুনলেখক
তাকবির জাহান
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক









