একের পর এক কারখানা বন্ধে টালমাটাল অর্থনীতি
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বৃহৎ মাধ্যম হলো পোশাক শিল্প এবং উৎপাদনশীল কলকারখানা। এই শিল্পগুলো শুধু যে রপ্তানির চাকাকে সচল রাখে সেটাই নয় বরং দেশের গ্রামীণ নারী-পুরুষ শ্রমিকদের জীবিকার ব্যবস্থা করে, নগরীর মেট্রোপলিটন ও বন্দরনগরীর কর্মসংস্থানের উৎস এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চেইনের প্রবাহ ঠিক রাখে । কিন্তু বর্তমান সময়ে অর্থনীতির এই মেরুদন্ড সংকটে দিন যাপন করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব, ব্যাংক ঋণের জটিলতা, বৈদেশিক ক্রেতাদের কার্যাদেশ কমে যাওয়া, এলসি জটিলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষ সব মিলিয়ে শিল্প খাত এখন বেসামাল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্ম দিয়েছিল, তা কেবল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনই করে নাই বরং সমাজ ,অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রেই বড় মোড় নিয়ে আসে।
যার ফলশ্রুতিতে পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া, ফার্নিচার এবং অন্যান্য উৎপাদনমুখী কারখানাগুলি আকস্মিকভাবে বন্ধে হতে থাকে।অভ্যুত্থানকালীন সময়ে প্রায় ১০০টিরও বেশি কারখানা লুটপাট এবং অগ্নিকান্ডের শিকার হয়, যার মধ্যে পোশাকশিল্প ছিল ৬০ টিরও বেশি। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এর তথ্য অনুসারে, এই ধ্বংসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এটি ছিল শুধু প্রারম্ভিক আঘাত। অভ্যুত্থানের পরের মাসগুলিতে অর্থাৎ আগস্ট থেকে অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত শ্রমিকদের অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরবরাহ চেইনের বিঘ্নের কারণে আরও ৩০০টিরও বেশি কারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে পৌঁছে এই সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে পোশাকশিল্পের অংশ ৭০ শতাংশ। এই বন্ধের ফলে প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিক চাকুরীচুত হয়, যা বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.৫ শতাংশের সমান। এখানেই শেষ নয়। অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও ভয় সৃষ্টি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা, যারা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬০ শতাংশ গ্রহণ করত, তারা বাংলাদেশের এই অস্থিরতা দেখে ধীরে ধীরে অর্ডার কমিয়ে দেয়। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও বড় ধাক্কার মুখোমুখি হয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আরএমজি (রেডি-মেড গার্মেন্টস) রপ্তানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২ শতাংশ কমেছে, যা ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে এসেছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে। এটি কেবল সংখ্যা নয়, বরং একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতির ১১ শতাংশ জিডিপি এবং ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় পোশাকশিল্প থেকে আসে। এবং এই শিল্পে ৪.৪ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োজিত, যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। এই একটা বিশাল অংশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এর পাশাপাশি এ সময়ে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং সাভারের কারখানাগুলিতে শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা উৎপাদনকে আরো ধীরগতি করে দেয়। এতে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক পক্ষ উভয়ের মাঝে এক বিশাল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ফলে বেশ কিছু মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়।
বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ এককালীন ১৫০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যা অক্টোবরে বেড়ে ২০০ ছাড়িয়েছে। যদিও এই বন্ধের পিছনে কারণগুলি ছিল বহুমুখী। প্রথমত, সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন, অভ্যুত্থানকালীন লুটপাটে কাঁচামালের গুদাম ধ্বংস হওয়া এবং ডলার সংকটে আমদানি ব্যাহত হওয়া। তাছাড়াও এ সময়ে গ্যাস এবং বিদ্যুতের ঘাটতিও প্রকট রূপে দেখা দেয় যার ফলে কারখানাগুলি দৈনিক ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সময়ে বিভিন্নভাবে দুর্যোগপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতেও বেশ বেগ পান। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক মালিক দ্বন্দ্ব বিভিন্ন জার্নালে এমন হাইলাইট করে প্রকাশ করা হয় যার ফলে ইউরোপীয় ক্রেতাদের আরো দূরে সরিয়ে নেয়। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো এই ফাঁকা জায়গা দখল করে নেয়। পোশাকশিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতগুলিও একই সংকটের শিকার হয়। টেক্সটাইল শিল্পে ২০২৪-এর চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ১৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ১ লক্ষ শ্রমিকের চাকরি যায়। চামড়া শিল্পেও অভ্যুত্থানের পর পরিবেশগত নিয়মকানুনের কঠোরতায় এবং রপ্তানি হ্রাসে ৮০টি কারখানা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ফার্নিচার এবং সিরামিকের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। গ্যাস সংকট এবং শ্রমিকের অভাবে ঢাকার আশেপাশের ১০০টিরও বেশি সিরামিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে বেকারত্ব বাড়ে এবং এর প্রভাব নারীদের উপর বেশি পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে এই বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে আরো বাড়বে। যা লৈঙ্গিক অসমতাকেও আরও গভীর করবে। এই কারখানা বন্ধের প্রভাব কেবল স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক।
২০২৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে ডিএকেএক্স ইনডেক্স ১৫ শতাংশ কমেছে যা সত্যিই দুঃখজনক। এই ধ্বংসের চক্র যদি না ভাঙে, তবে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে নেমে আসতে পারে বলেই বিজ্ঞজনের আশঙ্কা। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যেও এখনো আলোর রেখা আছে। এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তার জন্য এখনই শ্রমিক মহল এবং শিল্পপতিদের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে বসতে হবে। তাদের উভয়েরই সমস্যা শুনতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে অল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাদেরকে অভয় দিতে হবে এবং উভয়েরই জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য যা কিছু করা লাগে তার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ডিজিটালাইজেশন আনতে হবে। বাণিজ্য এবং অর্থনীতির স্বার্থে হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডে যে ফাটলগুলি দেখা দিয়েছে এগুলো কেবল কারখানার দরজা বন্ধ করেনি, এটি একটি জাতির স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগুন যদি পরিবর্তনের বীজ বপন করে থাকে, তাহলে আজ সবকিছু পূর্বের তুলনায় আরো ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে সেই বীজ থেকে ফসল উৎপাদন করতে হবে তবেই জুলাই অভ্যুত্থানের আসল সফলতা অর্জিত হবে।
আরও পড়ুনলেখক
প্রজ্ঞা দাস
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইডেন মহিলা কলেজ , ঢাকা।
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক









