শিক্ষকদের দাবি পূরণ

টানা দশদিন অবস্থান কর্মসূচির পর আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিরা। বাড়ি ভাড়া ভাতা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে শ্রেণিকক্ষে ফেরার সিদ্ধান্ত জানান তারা। বাকি দাবিগুলো আদায়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলবে জানান শিক্ষক নেতারা। এর আগে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর শিক্ষকদের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতার নিরিখে নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী ১ নভেম্বর থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা বাড়িয়ে মূল বেতনের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৬ সালের জুলাই থেকে আরও ৭ দশমিক ৫ শতাংশে বাড়িয়ে মোট ১৫ শতাংশ দেওয়া হবে। তবে ন্যুনতম বাড়িভাড়া ভাতা দুই হাজার টাকা হবে। উল্লেখ্য, শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ (সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা) বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ১,৫০০ টাকা এবং উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধির দাবিতে ১২ অক্টোবর থেকে রাজধানীতে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি আরও বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি যৌক্তিক। তবে ১৫ বছরের দুর্নীতি ও লুটপাটের ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতিতে এখনই পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সরকার বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শিক্ষকরা নব উদ্যমে শ্রেণিকক্ষে ফিরে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করবেন এবং জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবেন। মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র শিক্ষা উপদেষ্টা এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সভাপতি এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারী ফোরামের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজীর হাতে তুলে দেন। শিক্ষক নেতারা ইতোমধ্যেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং দাবি পূরণের পর আন্দোলন প্রত্যাহার করে শ্রেণিকক্ষে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে শনিবারও ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বাড়ি ভাড়া ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারির পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন শিক্ষকরা। ভবিষ্যতেও সব ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
আমরা মনে করি শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করে অন্তর্বর্তী সরকার এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করল। যুগের পর যুগ শিক্ষকরা অবহেলিত-বঞ্চিত থেকেছে। জীবন ধারনের জন্য ক্লাস ফেলে বারংবার তাদের ছুটে আসতে হতো ঢাকায়। মুদ্রাস্ফীতিতে পূর্ণ অর্থনীতিতে স্বল্প বেতনের এই সব শিক্ষকরা সংসার জীবন টেনে নিতে পারতো না। তাই ন্যায্য দাবি দাওয়া নিয়ে তারা ছুটে আসত রাজধানীতে-তাদের করুণ জীবনের ‘মহাকাব্য’ শোনাতে। শিক্ষকদের দাবিগুলো অযৌক্তিক নয়। বর্ধিত হারে বাড়ি ভাড়া ও ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা কোনো বিলাসী প্রত্যাশা নয়, বরং বর্তমান জীবনযাত্রার ও নিত্য পণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই দাবিগুলো পূরণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে বোঝা নয় বরং ন্যায্য দায়িত্ব। শিক্ষা ক্ষেত্র কখনই রাজনৈতিক বিরোধ বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার বলির পাঠা হতে পারে না। শিক্ষক সমাজকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কোনো সরকার দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারে না-ইতিহাসও তার সাক্ষ্য বহন করে। এটি কেবল অর্থ বরাদ্দের প্রশ্ন নয়, এটি একটি মূল্যবোধ ও দায়িত্বের প্রশ্নও বটে। একটি জাতি তার শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে না পারলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সে জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন বা সংশোধনের কাজও থমকে আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারে ১১টি কমিশন হলেও শিক্ষা খাতে কোনো কমিশন গঠন হয়নি, প্রাথমিক শিক্ষায় একটি পরামর্শক কমিটি হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি সামান্য। শিক্ষা খাতে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষকদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে যে উদারতা ও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন-তা প্রশংসনীয়। আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই।
মন্তব্য করুন