আজ বিশ্ব গ্রামীন নারী দিবস
বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গ্রামের নারীরা আশার আলো দেখাচ্ছেন

স্টাফ রিপোর্টার : সখিনা বেগম। বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা এলাকায়। স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তাদের ঘরে তিন ছেলে এবং এক মেয়ের জন্ম হয়। তখন একজনের আয়ে আর সংসার চলতে চায় না। গ্রামে কাজের তেমন মজুরীও নেই। তাই চলে আসেন শহরে। পাঁচ বাড়িতে ছুটা গৃহকর্মীর কাজ করে এখন তার মাসিক আয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। মাস শেষে সেই টাকা খরচ করার ক্ষমতা তার নেই। স্বামী রেজাউল টাকা নিয়ে নিজে তাকে শুধু পান খাওয়ার টাকা দেন। সংসারে অশান্তির ভয়ে সখিনা কোনো প্রতিবাদও করতে পারেন না। এমন অবস্থায় সখিনা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়তি টাকা পেলে এখন আর স্বামীকে বলেন না। নিজের কাছে রেখে ইচ্ছেমত খরচ করেন। এভাবে টাকা জমিয়ে সখিনা গ্রামে একটি বাড়িও করেছেন। সাথে ছেলেদের এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়ে গার্মেন্টস ও গাড়ির ড্রাইভিং শিখিয়ে কর্মমূখী করেছেন।
সখিনার মত এদেশের গ্রামীন এলাকার বেশিরভাগ নারীর অবস্থা একই রকম। তবে আগে যেখানে শুধুমাত্র পেট ভরে খাওয়ার বিনিময়ে নারীরা অন্যের বাড়ি, কৃষির মাঠে কাজ করতেন এখন মজুরী বৈষম্য হলেও নারীরা আর শুধু পেটেভাতে কোনো বাড়িতে এবং কৃষিমাঠে কাজ করে না। পুরুষের পাশাপাশি বর্তমানে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। পুরুষের সঙ্গে সমান সময় দিয়েও কাজ করেন। কিন্তু মজুরি পান অপেক্ষাকৃত কম। এ ছাড়া পরিবারে বেশি সময় দিয়েও এর অর্থনৈতিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কৃষি খাতে অবদান রাখলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পান না মজুরি। সব মিলিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত-নির্বিশেষে কর্মক্ষেত্রে নারী এখনো বৈষম্যের শিকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংস্থাটির শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য বলছে, দেশে এখন শ্রমক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয়ভাবে শ্রমশক্তিতে যুক্ত আছে সাত কোটি ১৭ লাখ মানুষ। নারী শ্রমশক্তি দুই কোটিরও বেশি, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ১০ বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ, এখন বেড়ে প্রায় ৩৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বড় এক ফারাকের কথা। পুরুষদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ যেখানে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ, সেখানে নারীদের হার অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ সক্ষম নারীদের বিশাল একটি অংশ এখনও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না।
অন্য দিকে গ্রামীন নারীদের মধ্যে অনেকে সংসারের কাজ সামলে উদ্যাক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। তারা নিজেরা সকল বাধা পেরিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এমনই কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা শেরপুর উপজেলার কল্যানী গ্রামের সুলেখা, সালমা বেগম, তৌহিদা বেগম। তারা দর্জির কাজ করেন, ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরি করছেন, কুশিকাটা দিয়ে টুপি শেলাই করেন। শুধু তাই নয়, তারা এই কাজে আরও নারীদের সম্পৃক্ত করেছেন। এতে তাদের নিজদের খরচ চালাতে পারছেন এবং সাথে সংসারে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা ফিরে আনছেন। তাদের এই সাফল্যের জন্য তারা নিজেদের মত করে নিজেরা কিছুটা হলেও সিন্ধান্ত নিতে পারেন। তবে তা প্রায় হাতে গোনা। এসব সাফল্যের উল্টোপিঠে আছে আবার প্রকট বৈষম্যের চিত্র।
দেশের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী এখনও এদেশে ৮৫ শতাংশ পরিবার পুরুষ দ্বারা পচিালিত হয়। মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবারের নেতৃত্বে আছেন নারী। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে নারী এবং পুরুষের মজুরি বৈষম্য প্রকট। কৃষিতে এবং নির্মান শ্রমিকসহ অন্যান্য কাজে একজন পুরুষ দৈনিক ৫০০ টাকা পেলেও নারী শ্রমিক পায় সাড়ে তিনশ থেকে ৪০০ টাকা করে।
আজ বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় আন্তজার্তিক গ্রামীন নারী দিবস। দিনটি মূলত গ্রামীন অর্থনীতি খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নে গ্রামীন নারীদের বিশাল ও অপরিহার্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই নিবেদিত। বাংলাদেশের মত কৃষিনির্ভর দেশে গ্রামীন নারীরাই খাদ্যশস্য উৎপাদন, কৃষি উন্নয়নের নিরব কারিগর।
মন্তব্য করুন