জুলাই স্মৃতিস্তম্ভয়ে শহিদদের নাম পায়ের কাছে লেখায় বগুড়ায় সমালোচনার ঝড়

রাহাত রিটু : বগুড়ায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ‘র বেজমেন্টের উপর স্তম্ভ স্থাপনের পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শহিদদের নাম পায়ের কাছে লেখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভ শহিদদের স্মরণ নয় তাদেরকে অপমান করা হয়েছে বলে মনে করেন শহিদ পরিবারের সদস্য এবং জুলাই যোদ্ধারা।
গত ২০ জুলাই বগুড়া শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথায় ভেঙ্গে ফেলা মুজিব মঞ্চের স্থলে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। গনপূর্ত বিভাগ বগুড়া এটি বাস্তবায়ন করেছে। এর জন্য ব্যায় হয়েছে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। গনপূর্ত বিভাগ বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ড. ফারজানা আকতার জানান, সারা দেশের জন্য একই নকশায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হচ্ছে। এখানে তাদের কিছুই করার নাই। তিনি জানান, পুরো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান ব্যায় ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এর মধ্যে শুধু স্তম্ভের অংশের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা। তিনি আরও জানান, উচ্চ মহল থেকে নকশা অনুমাদনের পর তারা কাজ করেছেন। একাধিক মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং সেই ভিত্তিতে এটি নির্মান করা হয়েছে।
এদিকে এই জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে বগুড়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ফেইজবুকে চলছে সমালোচনা।সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সভঅপতি গনেশদাস তার ফেইজবুক পেজে ‘বগুড়ায় জুলাই স্মৃতি স্তম্ভের দিনে ও রাতের চিত্র। ছিন্নমুল মানুষ আর কুকুরে দখলে’ শিরোনামে তিনি লেখেন, জুলাই স্মৃতি স্তম্ভে শহিদদের নাম পায়ের নিচে! শহিদদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি দিয়েছে, অথচ তাদের নাম আজ পায়ের নিচে! মানুষের জুতোর তলায় পদদলিত হচ্ছে! এটি শহিদদের প্রতি অবমাননা, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি অবহেলা। শহিদদের নাম হওয়া উচিত আকাশের মতো উঁচু, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চোখে অনুপ্রেরণা! কিন্তু সেই নামগুলো যদি পড়ে থাকে ধুলো-বালির নিচে, মানুষের পায়ের নিচে, তবে তা জুলাই স্মৃতিকে সম্মানিত করে না, বরং আঘাত করে।
স্মৃতিস্তম্ভ হোক শহীদদের শ্রদ্ধার জায়গা, যেখানে মাথা নত হয়ে আসে, বুক ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। শহীদের নাম থাকুক চোখের সামনে, হৃদয়ের উপরে,পায়ের নিচে নয়! তার এই পোস্টে আনেকেই মন্তব্য করে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে জুলাইযোদ্ধা সাকিব খান বলেন, জুলাই স্মৃতি স্তম্বের প্লানিয়ে ভুল হয়েছে। যা করা হয়েছে তা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায়না।এর মাধ্যমে শহিদদের অবমাননা করা হয়েছে। খবর নিয়ে দেখা দরকার এর মধ্যে কোন গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা। যারা শহিদের নাম পায়ের তলায় রেখেছে তাদেরকে এর দায়ভার নিতে হবে। এটি উপর মহলের ব্যর্থতা। তিনি দাবি করে বলেন নতুন করে ডিজাইন করে শহিদদের নাম উপরে স্থাপন করতে হবে। কোন দোসর এর সাথে জড়িত কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
বগুড়ার সর্বকনিষ্ঠ শহিদ রাতুলের বাবা মো.জিয়াউর রহমান বলেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে জুলাই বিপ্লব হয়েছে সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। ভবিষ্যতে হবে কিনা জানি না। স্মৃতিস্তম্ভতে পায়ের কাছে শহিদ দের নাম লেখা হয়েছে যা মোটেও ঠিক নয়। উপর মহলের লোকজন জ্ঞান হারা হয়ে গেছে নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছে তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, কোন নিয়মে শহিদদের নাম নিচে লেখা ঠিক হয়নি। তিনি ডিজাউন চেঞ্জ করে নাম উপরে খেলার ব্যবস্থা করার দাবি জানান। তিনি বলেন এই বিষয়টি নিয়ে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে যাবেন। এবং পরিবর্তনের দাবি জানাবেন।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন ডিজাইন করার সময় তিনি শহিদদের নাম নিচে না লিখে উপরে লিখতে বলেছিলেন কিন্তু সেটা নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, গণপূর্ত বিভাগ স্মৃতিস্তম্বের চারপাশে এসএস গ্রিল দিয়ে ঘিরে দিবে। বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুনউল্লেখ্য জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সারা বাংলাদেশ জুড়ে অভিন্ন নকশায় করা হচ্ছে ‘জুলাই গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার দেশের ৬৪ জেলায় এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে জুলাই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ২৪ জুন ২০২৫ সালে সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপনের উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচিতে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। জুন ২০২৫ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। উক্ত কমিটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় অভ্যুত্থানকে উৎসর্গ করে একটি করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এর জন্য শিল্পী আব্দুল হালিম চঞ্চলের করা স্মৃতিস্তম্ভের প্রস্তাবিত নকশা সরকার কর্তৃক গৃহীত হয় যা ৯ জুলাই ২০২৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম অনুমোদন করেন। অনুমোদন পর প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসকদের নির্মাণস্থল চিহ্নিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
৬৪টি স্মৃতিস্তম্ভের জন্য গড়ে প্রায় ১৪ লাখ টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়। ৯ জুলাই ২০২৫ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়।
স্মৃতিস্তম্বের নকশাকার শিল্পী আব্দুল হালিম চঞ্চল একজন দৃশ্যশিল্পী, শিক্ষক ও লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন (২০০৯-২০১৪) এবং বর্তমানে সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করছেন।
মন্তব্য করুন