শাওন রহমান
যন্ত্র যখন যন্ত্রণাদায়ক

বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের যতগুলো বিষ্ময়কর যন্ত্র আছে তারমধ্যে মোবাইল ফোন অন্যতম। বিনাতারে বিশেষ ধরনের শব্দ তরঙ্গ মাধ্যমকে ব্যবহার করে এই যন্ত্রে কথা বলাসহ অন্যান্য আরও অনেক কাজ করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৩ এপ্রিল বিশ্বে প্রথম মোবাইল যন্ত্র আবিষ্কার করেন মটোরোলা কোম্পানির গবেষক মার্টিন কুপার। এই ফোনের নাম ছিল DynaTAC 8000X এটি ছিল একটি হাতে ধরার মতো আকারের ফোন, যা টেলিফোন কল, টেক্সট মেসেজিং এবং ক্যালেন্ডারসহ কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সমর্থন করত।
তবে, স্মার্টফোনের আধুনিক সংজ্ঞা অনুসারে, যা একটি ক্ষুদ্র কম্পিউটার যা যোগাযোগ, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে সমর্থন করে, সেখানে কোনও একক আবিষ্কারক নেই। স্মার্টফোনের বিকাশে বেশ কয়েকটি কোম্পানি এবং ব্যক্তির অবদান রয়েছে। মাইক্রোসফট ১৯৯৬ সালে প্রথম স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেম, Windows CE ১.০ চালু করে। আজ, স্মার্টফোন আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এ ধরনের নতুন নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করছে, ঠিক তেমনি এসব যন্ত্র নির্ভরতা মানুষের নানাবিধ ক্ষতির কারণ হয়েও দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ তথা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মুঠোফোন অপারেটর ‘সিটিসেল’ যাত্রা শুরু করে ১৯৮৯ সালে। প্যাসিফিক টেলিকম লিমিটেড কোম্পানির ‘সিটিসেল’ মুঠোফোন অপারেটরের ব্যবসার ধরন ছিল সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল এ্যাকসেস) সেবা। এরপর ১৯৯৭ সালে আসে জিএসএম প্রযুক্তি (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন্স)’র ‘গ্রামীণ ফোন’।
বিটিআরসির হিসাব বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে মোবাইল গ্রাহক ছিল ১৯ কোটি ৮ লাখ। ওই বছরের গড় হিসাবে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটি ৬৫ লাখ। তবে বিবিএস’র সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে মোবাইল ব্যবহারকারী মোট জনসংখ্যার ৭৪.২ শতাংশ, সংখ্যার হিসাবে যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৫৯ লাখ। আর ষষ্ঠ জনশুমারি অনুযায়ী দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশই স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। বর্তমানে সিম ব্যবহার হচ্ছে ১৯ কোটিরও বেশি (চলমান)। অর্থাৎ একজন একাধিক সিম ব্যবহার করছেন। অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) সূত্র এ তথ্য জানায়, সিম ব্যবহারকারীদের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭৪ লাখ। আর মোট জনসংখ্যার ৯৮.৫ শতাংশ ফোরজির আওতাভুক্ত।
মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশই স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ মোবাইল বাজার বাংলাদেশ।
ওপরের তথ্য বলছে-দেশের ১৭ কোটি মানুষ, ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার সিম ব্যবহার করছে। যদিও এ বছরের চলতি মাসগুলোর হিসাব ধরলে এই সংখ্যা আরও বেশি। মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন ব্যবহারের তথ্য বলছে, কতটা এগিয়েছে এ দেশের মানুষ।
ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে বাঙালি কতটা বৈশ্বিক হয়েছে কিংবা, যখন মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশই স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন তখন জাতি হিসেবে আমরা কতটা স্মার্ট হয়েছি? মোবাইল ফোন তথা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে আমরা কী স্মার্ট মানুষ পেয়েছি? পাইনি। মানুষের পতনের কত শত শব্দ আজ আমাদের কানে বাজে। এই স্মার্ট ফোনের যুগে মানুষ যে কীভাবে মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়েছে তার নানা নজির আজ চোখ না খুললেও চোখে পড়ছে।
স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলোতে মানুষের বিবেকহীনতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের স্মার্ট ফোন। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত গুজব ছড়ানোর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশি প্রভাব ফেলেছে। কিছু কুচক্রী ব্যক্তি সমাজের মধ্যে কৌশলে গুজব ছড়িয়ে দেয়। এসব গুজব যখন সমাজে ছড়ায় তখন সমাজে বসবাসরত মানুষ শুধু ওই সব বিষয়ের ওপর নজর দেয়, ফলে কুচক্রীমহল তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারে। এছাড়া কেউকে ছোট করা বা বিপদে ফেলার জন্য এসব কৌশল অবলম্বন করা হয়।
এর বাইরেও আছে যান্ত্রিক ক্ষতি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল থেকে নির্গত হওয়া আলোর মধ্যে সাতটি রঙের রশ্মিই থাকে। কিন্তু এর মধ্যে নীল রশ্মি সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই এটি ক্ষতিও করে সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসকরা বলছেন, মোবাইল ফোন যে নীল আলো ছড়ায়, রুমের লাইট নিভিয়ে দেওয়ার কারণে রাতে সেটি আরও তীক্ষè হয়ে যায়। পাশাপাশি এর ব্যবহারে মাথা, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা অনুভূত হতে দেখা যায়।
আরও পড়ুনচোখে শুষ্ক বোধ করা, চোখে চুলকানি হওয়া, চোখে ঘোলা দেখা, দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হওয়া, এমনকি রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্মার্টফোনের আলো ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের কাজেও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, ফলে স্থুলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশুদের ক্ষতির হার আরও বেশি। শিশুর মোবাইল ফোন আসক্তি কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় তার চিত্র ফুটে উঠেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হকের তত্ত্বাবধানে ওই গবেষণা প্রতিবেদন গত বছর এপ্রিলে আন্তর্জাতিক জার্নাল এলসভিয়ারের জার্নাল অব ইফেক্টিভ ডিস-অর্ডারে প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় উঠে আসে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশুর মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা যায়, ৯২ শতাংশ শিশু তাদের মা-বাবার স্মার্টফোন ব্যবহার করে আর ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে।
এছাড়াও টেলিকম অপারেটরদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিয়ন্ত্রণহীন টাওয়ারের কারণে বিশাল এক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে এ দেশের মানুষ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এইসব টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি দৃশ্যমান না হওয়ায় আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। যদিও যে কোন ধরনের তেজস্ক্রিয়তাই মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
উন্নত দেশগুলোতে আবাসিক এলাকা ছেড়ে দূরে টাওয়ার স্থাপন করা হলেও, এখন পর্যন্ত এ নিয়ে দেশে কোন নীতিমালা পর্যন্ত নেই। আবাসিক এলাকায় স্থাপিত এ ধরনের টাওয়ার বেশি ক্ষতি করে শিশু ও প্রসূতিদের। মোবাইলে কথা না বললেও এই তেজস্ক্রিয়তা আমাদের ক্ষতি করে। মোবাইল চালু থাকলে তাতে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আসতে থাকে। মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলার সময় সেটি মস্তিষ্কের একেবারে কাছে চলে আসে, আর এই বিকিরণ প্রবাহিত হতে থাকে সারা শরীরে।
ব্রেন টিউমার, ক্যান্সার, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা রোগের কারণ হলো এই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এছাড়াও নিয়ম বহির্ভূত মোবাইল টাওয়ারের কারণে বিভিন্ন ধরনের পাখি, মৌমাছি, বাদুড় এবং দেশিয় নানা জাতের গাছ যেমন-ডাব, নারিকেলসহ আরো অন্যান্য বৃক্ষরাজি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্মার্ট ফোনের ব্যবহার ও এর আসক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ভঙ্গুর জাতি হিসেবে গড়ে তুলছে। আসলে প্রযুক্তি কখনো আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে, আবার কখনো তা বয়ে আনে অভিশাপ। নির্ভর করছে আপনি কীভাবে এটিকে ব্যবহার করছেন, তার ওপর।
যন্ত্রের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের এই যন্ত্র ব্যবহারে আরও সচেতন হতে হবে। স্মার্ট ফোন ছাড়া জীবন যাপন করা বর্তমানে খুবই কষ্টসাধ্য। তাছাড়া মানুষের যাপিত জীবনকে সহজ ও সুন্দর করতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা দীর্ঘদিন ধরে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে অভ্যস্ত, তাদের জন্য একটি দিনও এই যন্ত্র ছাড়া চলা প্রায় অসম্ভব।
যেহেতু এই যন্ত্র ছাড়া চলা অসম্ভব, তাই সন্তানকে বেশি বেশি সময় দেওয়ার পাশাপাশি বাবা-মাকেও স্মার্ট ফোন ব্যবহারে হতে হবে সতর্ক এবং আরও সচেতন। প্রয়োজনে ব্যবহার এবং অপ্রয়োজনে পরিহার করতে পারলেই মুক্তি মিলতে পারে এই যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন