শহিদ আবু সাইদ হত্যার বিচার জীবদ্দশায় দেখে যেতে চান পরিবারের সদস্যরা

রংপুর জেলা প্রতিনিধি : ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে আবারও এলো জুলাই মাস। জুলাই আন্দোলনে উত্তাল যখন দেশ তখনই আলোচনায় আসে রংপুর জেলা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর জিলা স্কুলসহ পুরো জেলাই তখন সংগ্রামে উত্তাল। সময়ের পরিক্রমায় আবারও এলো জুলাই শাহদ দিবস। আজ শহিদ আবু সাইদের প্রথম শাহাদৎ বার্ষিকী।
আবু সাঈদ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। আবু সাঈদ ভাই ও বোনের মধ্যে সবার ছোট। তিনি ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৬ জুলাই বেলা আড়াইটা থেকে ৩টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। ছাত্রদের সবাই সরে গেলেও আবু সাঈদ হাতে একটি লাঠি নিয়ে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। এই অবস্থায় পুলিশ তার ওপর গুলি ছুঁড়ে। তারপরও অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ, দাঁড়িয়েই ছিলেন।
এক পর্যায়ে কয়েকটি গুলি খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনের শহিদ আবু সাইদের মৃত্যুর ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে তার বাবা মকবুল হোসেন বলেন, হঠাৎ খবর আসে আবু সাইদের গায়ে গুলি লেগেছে। মুহূর্তেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়।
পরিবারের সদস্যরা রংপুরে গেলেও লাশ দেখা নিয়ে চলে অনেক নাটকীয়তা। পরে রাতে লাশ নিয়ে এলেও আমি মুখ ছাড়া কিছুই দেখতে পারিনি। পুলিশের চাপ আর জরুরি দাফনের ব্যবস্থা করতে সবাই ব্যস্ত। স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পরে আমার বাসায় জনতার ঢল। আজও আমার ছেলে আবু সাইদের হত্যায় যারা আসামি তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। আমি বেঁচে থাকতেই আমার সন্তানের হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।
শহিদ আবু সাইদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আজও সব আছে, কিন্তু আবু সাইদ নেই। পাখির মতো গুলি করে আবু সাইদকে শহিদ করা হয়। যারা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক এবং বিচার করা হোক।
শহিদ আবু সাইদের ভাই রমজান আলী জানান, আবু সাইদের মৃত্যুর পরেও দোষীরা আছে বহাল তবিয়তে। অনেকে এখনও গ্রেফতার হয়নি। বিচার প্রক্রিয়া ধীর গতি হওয়ায় অনেকটাই কষ্টে আছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। জীবদ্দশায় হত্যাকারীদের বিচার দেখে যাওয়ার আকুতি জানালেন তিনি। এছাড়াও শহিদ আবু সাইদ ফাউন্ডেশন করে আমরা কর্মের মধ্যে আবু সাইদকে বেঁচে রাখতে চাই।
আরও পড়ুনরংপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, শহিদ আবু সাইদ ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল রংপুর জেলা। তিনি প্রথম শহিদ। আজ তার শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমরা নতুন বাংলাদেশ গঠনে তার স্বপ্নকে ধারণ করি।
শহিদ আবু সাইদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শওকাত আলী বলেন, আবু সাইদের আন্দোলন আর সংগ্রামে পিছপা না হওয়ার উদ্দীপনা এখন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থরা বুকে ধারণ করে আছে। জুলাই শহিদ দিবসের কর্মসূচি আর শহিদ আবু সাইদের জীবন উৎসর্গে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে বেরোবি শিক্ষক ও নতুন প্রজন্মের নেতারা। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে পারলেই শহিদ আবু সাইদের জীবন দান হবে সার্থক। তার স্বপ্নের রুপদান হবে বাস্তব। শোষণহীন আর অধিকার আদায়ে শহিদ আবু সাইদ হবে নতুনদের প্রেরণা।
শহিদ আবু সাইদের প্রথম শাহাদৎ বার্ষিকীতে রংপুর জেলা প্রশাসন ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৭টায় পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়ার বাবনপুর গ্রামে শহিদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত।
সকাল সোয়া ৯টায় বেরোবি’র প্রশাসনিক ভবনের দক্ষিণ গেটে কালো ব্যাজ ধারণ ও শোক র্যালির আয়োজন, বেলা ১০টায় শহিদ আবু সাঈদ গেটে শহিদ আবু সাঈদ তোরণ ও মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সোয়া ১০টায় পার্কের মোড়ের শহিদ আবু সাঈদ চত্বরে শহিদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, বেরোবি’র স্বাধীনতা স্মারক মাঠে সকাল সাড়ে ১০টায় জুলাই শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন শহিদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন জুলাই আন্দোলনে শহিদের পরিবারবর্গ।
এছাড়াও সম্মানিত অতিথি থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান।
সভায় সভাপতিত্ব করবেন বেরোবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শওকাত আলী। শেষে বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বিকেল সাড়ে ৫টায় কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
মন্তব্য করুন