সুপেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট
পানির আরেক নাম জীবন হলেও নগর জীবনে পানি নামে আমরা যা খাচ্ছি তা ক্ষতিকর বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ছোট-বড় ২৩০টি নদী বয়ে নিয়ে সমুদ্রে মিশেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৫৭টি নদী যৌথ বা আন্তর্জাতিক। যৌথ নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টির উৎসস্থল ভারত আর বাকি ৩টির উৎস মিয়ানমার। কিন্তু উৎসে আর অন্তে অবারিত পানির আধার হলেও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশ সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে খুবই দ্রুতগতিতে।
বাংলাদেশের সুপেয় পানির সংকট নিয়ে ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭কোটি ১০ লাখ মানুষ সুরক্ষিত সুপেয় পানি পাচ্ছে না এবং ৬৮ শতাংশ মানুষের সুরক্ষিত পয়:ব্যবস্থাপনায় সুযোগ নেই। এই হিসাব অনুসারে দেশের প্রতি একশ জনে সুরক্ষিত পয়: ব্যবস্থাপনার সুযোগ আছে একশ জনের ৩২ জনের। সংকটময় এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারি-বেসরকারি নানা পরিকল্পনা-কর্মসূচি থাকলেও দুয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের সাংবাদিক জোয়ান হারি জলবায়ু বিষয়ক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন-‘বাংলাদেশ; রক্তে যার জন্ম, লবণাক্ত পানিতে তার মৃত্যু’। এমন লেখার কারণ ব্যবহারোপযোগী পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে এ দেশটিতে। লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণ আর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানীয় জলের সংকট ভুগছে বাংলাদেশ।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পুষ্টি ও সার্বিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার উন্নয়নে এখনো অনেক কিছু করণীয় আছে। যেমন-বিশুদ্ধ বা নিরাপদ খাওয়ার পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কার্যকর পয়:নিষ্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাসস্থান -গৃহস্থালি ও কর্মস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি, পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। দেশে এখন পর্যন্ত ৫৯ শতাংশ নিরাপদ পানি পাচ্ছে মানুষ।
এই হিসাবে দেশের পানীয় জলের ৪১ শতাংশই অনিরাপদ। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে এখনো পাহাড়ি অঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে প্রতি বছর পানির স্তর ২ মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনএর পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বাড়ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। তবে শুধু অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই চলবে না। এই অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
নদীগুলোতে নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং প্রবাহ ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো গেলে বন্যা ও নদী ভাঙন ও নিশ্চয়ই হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের পক্ষেও আমরা। বাংলাদেশ যে বিশ্বের শীর্ষ দশ বৃষ্টি বহুল দেশের একটি বৃষ্টির পানির ব্যাপারে আমাদের সাংস্কৃতিক ও কারিগরি প্রবণতা দেখে তা বোঝার অবকাশ নেই। আমাদের দেশে বৃষ্টির উপযোগিতা মূলত সাহিত্য চর্চার মধ্যেই সীমিত।
অথচ এত পরিষ্কার ও সুপেয় পানি আর কোনো উৎস থেকে পাওয়া যায় না বলে বিশ্ব জুড়েই বৃষ্টির পানির কদর সবচেয়ে বেশি বিশেষত রাজধানীসহ শহরগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ উপরিস্থ পানির ওপর চাপ কমানো যায় অনায়াসেই। নতুন বাস্তবতায় সুপেয় পানি সংকট মোকাবেলা করতে হলে ঘরে ও বাইরে প্রস্তুতি নিতেই হবে আমাদের। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই সময়। জনবান্ধব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এমনটিই সাধারণের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন