ভিডিও শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৫:২২ বিকাল

ওসমান হাদি: থেমে গেল দ্রোহের কন্ঠস্বর

দ্রোহের কন্ঠস্বর অগ্নিগর্ভ এক মানুষ। আগুনে আগুন ঘষে উড়ে যাওয়া এক নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি যেন সূর্যের সন্তান। শরিফ ওসমান বিন হাদি বা ওসমান হাদি ছিলেন একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা,শিক্ষক। যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। হাদি জুলাই শহিদদের অধিকার রক্ষা ও আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী সক্রিয় রাজনীতির জন্য আলোচনায় আসেন। ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি জুমার নামাজের পর ঢাকার বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশের জুলাই আন্দোলনের জন্য এক সাহসী নাম ছিল হাদি। জন্মেছিলেন এই মাতৃভূমির ঝালকাঠি জেলার নলছিটিতে শরিফ ওসমান বিন হাদি ৩০ জুন ১৯৮৩ তে। 

হাদি একটি নাম। হাদি একটি প্রতীক। হাদি একটি বিশ্বাস। হাদি কোন বিশেষ দেশ বা স্থানের নয়। শিকাগোর হেনরি আর রাশিয়ার তানিয়ার অপর নাম যেন হাদি। সারা বিশ্বের মুক্তিপাগল শেকল ভাঙা দামাল ছেলেদের নাম হাদি। ক্ষয়ে যাওয়া নয়, ঝরে যাওয়া নয়, কালের গহ্বরে জন্ম নেওয়া নতুন কোন গ্রহ কিংবা নক্ষত্রের নাম হাদি। ওসমান হাদি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম ছিলেন। ৬ ভাইবোনের মধ্যে হাদি সর্বকনিষ্ঠ। হাদি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে, সেখান থেকে তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে চতুর্থ শ্রেণিতে ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন, সেখানে তিনি আলিম পরীক্ষা সম্পন্ন করে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

হাদি ইংরেজি শেখার একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করছিলেন। কাছে পরিচিত হলেন মাস্টার ভাই নামে। স্কুল মাস্টারির সুবাদে ‘মাস্টার ভাই’ নামকরণ সেটা তাঁর চেহারার সঙ্গে সম্পূর্ণ মানান সই। শক্ত চোয়াল এলোমেলো মাথায় বাবরি চুল। তার্কিক এই স্কুল মাস্টারের চেহারায় আর যাইহোক তাঁকে কেউ জুলাই বিপ্লবী দলের সদস্য হিসাবে ভাববে না। 

২০২৪ সালে হাদি সীমান্ত শরিফ ছদ্মনামে দুয়ার প্রকাশনী থেকে ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। জুলাই আন্দোলনের সময় তিনি স্থানীয় সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন এবং রামপুরা এলাকার সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে হওয়া আন্দোলনে হাদিকে অন্যতম তরুণ নেতৃত্বদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়

ইনকিলাব মঞ্চ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার অভিজ্ঞতা ও দাবির ভিত্তিতে গঠিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চ শরিফ ওসমান হাদির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য হলো সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং “ইনসাফভিত্তিক” একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন, যেখানে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচার প্রধান মূল্যবোধ হিসেবে থাকবে। ইনকিলাব মঞ্চ গঠনের পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষা, অপরাধীদের বিচার, আহত-নিহত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি এবং জুলাই চার্টার ঘোষণার দাবি তুলেন হাদি। যা তাকে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। 

আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন : ২০২৫ সালে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবিতে “ন্যাশনাল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ইউনিটি” ব্যানারের অধীনে যে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেখানে ইনকিলাব মঞ্চ অন্যতম অংশগ্রহণকারী সংগঠন হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ইনকিলাব মঞ্চের মাধ্যমে হাদি আওয়ামী লীগের দমন-পীড়ন ও হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করে নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলে ধরেন এবং দাবি না মানলে সচিবালয় ঘেরাওয়ের হুমকি দেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণা দিলে ওসমান হাদি ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে দল ও ব্যক্তির বিচার করার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরপরাধ কর্মীদের প্রায়শ্চিত্তের জন্য কমিশন গঠন এবং ৫ আগস্ট ২০২৫ সালের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং দৃশ্যমান পরিবর্তনের ঘাটতির সমালোচনা করে হাদি সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। 

আরও পড়ুন

ঢাকা-৮ আসন থেকে প্রার্থিতা : ২০২৫ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন শরিফ ওসমান হাদি। মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত এই আসনে তিনি প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় ও “চা-সিঙ্গারা” আড্ডার আয়োজনের কথা জানান। এছাড়া তিনি জনগণের পরামর্শ অনুযায়ী তার নির্বাচনি ইশতেহার ঠিক করবেন বলে ঘোষণা দেন। তার এই ভিন্নধর্মী প্রচারণা নাগরিক সমাজে ব্যাপক প্রশংসিত হয় এবং গণমাধ্যমে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।

নির্বাচনি প্রচারণায় কর্মী সমর্থকদের মধ্যে মুড়ি-বাতাসা বিতরণের ছবি নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনায় আসেন তিনি। এছাড়া ভোররাতে মসজিদের সামনে লিফলেট বিতরণ, ডোনেশনের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন এবং অর্থের হিসাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদান করা তাকে ক্রমে জনপ্রিয় করে তোলে। সম্প্রতি নির্বাচনি প্রচারণার সময় ওসমান হাদির পকেটে একজন টাকা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, এমন একটি ভিডিয়ো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে অবস্থান : ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বিরুদ্ধে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শরিফ ওসমান হাদি মন্তব্য করেন যে এই রায় “পুরো পৃথিবীর জন্য নজির স্থাপন করেছে” এবং কোনো স্বৈরাচার দীর্ঘকাল মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যেতে পারে না।  হাদির অন্তিম দিনলিপি। ১২ ডিসেম্বরে পল্টন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ১৫ ডিসেম্বরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। ১৮ ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

ওসমান হাদির মৃত্যুর পর বত্রিশ নাম্বার,  প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটে হামলা অরাজকতা বাংলাদেশের মানুষ আর দেখতে চায় না। ওসমান হাদিও চাননি তিনি  স্বপ্ন দেখতেন ইনসাফ এর রাষ্ট্র দেখতে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বৈরিতা থাকবে না, এটা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে টালবাহানা যেমন আমাদের ওপর ভারতের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য, তেমনি ছিটমহল থেকে সসমুদ্রসীমা জয়--এগুলো আমাদের অর্জন। চিকেন নেক কিংবা ফক্স নেক নিয়ে ভোটের রাজনীতি হবে; কিন্তু মেধা তৈরি হবে না। আমাদের এমন বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল দরকার--যেখানে মবস্টার তৈরি হবে না, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার তৈরি হবে, বিজ্ঞানী তৈরি হবে। আমরা তা পারছি না। আমরা নিজেদের ঘৃণার স্তম্ভে নিজেদেরই ছায়া তৈরি করে চলেছি দশকের পর দশক। কাউকেই ঝুলতে দেখতে চাই না। আমাদের ভাইয়েরা মব হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠুক। এই চেহারাগুলো রক্ত পান থামিয়ে জ্ঞানের রস পান করা শিখুক সবাই। 

১২ ডিসেম্বর ২০২৫। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যু  হলো ওসমান হাদির । গুলিতে হাদির মৃত্যু নেই। হাদিরা মরে না কখনো। রফিক, সালাম, বরকত, মতিউর, নূর হোসেন কে ছুঁয়ে জাতির প্রয়োজনে কি করে জাগে লাখ লাখ হাদি। মাটিকে স্বাধীন করার পর মানুষের স্বাধীনতার জন্য যতোবার মরে, সংখ্যায় বাড়ে ওসমান হাদিরা। পুরানো হয় না হাদিরা।  

মাহমুদ হোসেন পিন্টু

সাংবাদিক,প্রাবান্ধিক

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শহিদ হাদির দেহবাহী গাড়ি ঘিরে উত্তেজনা : নিয়ন্ত্রণ নিলেন হাসনাত

গজারিয়ায় প্রতিবেশী দুই ভাইয়ের ঝগড়া থামাতে গিয়ে দায়ের কোপে যুবকের মৃত্যু

ওসমান হাদি: থেমে গেল দ্রোহের কন্ঠস্বর

ওসমান হাদি : ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক অগ্রনায়ক

ওসমান হাদির মৃত্যুতে কমনওয়েলথের শোক প্রকাশ

বাগেরহাটের দুই আসনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত