ভিডিও শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৫:০৯ বিকাল

আধিপত্যবাদ বিরোধী কণ্ঠস্বর শহীদ ওসমান হাদি

চোখের পানির জন্য মনিটর ঘোলা দেখছি। আঙুলগুলো ঠিকভাবে কি-বোর্ডের বোতামে পড়ছে না। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, “ জান দেব তবু জুলাই দেব না।” কিছুটা শোক আর বাকিটা ক্ষোভ উত্তপ্ত আগুন। সবটা মিলে নিস্তব্ধতা যেন এক নীরব বিস্ফোরণ। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর শহীদ ওসমান হাদি। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের অঙ্কুরিত স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হাদির চলে যাওয়া। আমার মনে হয় হাদির জীবনে একটি ভুল ছিল সে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিকে ভারতের দাসত্ব করতে দিতে চায়নি। বদলে দিতে চেয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির বস্তাপচা প্রচলিত সংস্কৃতি। মুড়ি-বাতাসা হাতে ভ্যান গাড়িতে বাংলার মানুষ অতীতে কখনো রাজনীতি করতে দেখেছে কিনা জানি না, তবে আগামীতে দেখবে। বুলেটপ্রুফ গাড়ির রাজনীতিকে হাদি নিয়ে এসেছেন রাস্তার ভ্যান গাড়িতে। হাদির এই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নতুন প্রজন্ম হৃদয়ে ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা, জুলাই শহীদ ও আহতদের রক্ষায় একচুলও আপস করেননি হাদি। হাদি বারবার গর্জে উঠেছিলেন দুর্নীতি, দু:শাসন, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। লড়াই করেছেন ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে। বড় তিনটি রাজনৈতিক দলকেই শাসন করেছেন সমান তালে। 

বুলেট যদি খাদ্য হতো, /খেতাম তবে মগজ ভরে।/রক্ত হলে বর্ণমালা,/হাদির পরে আমার পালা।/আমরা সবাই হাদি হব, /গুলির মুখে কথা কব। ন্যায়ের পক্ষে হাদির ডাক, /আধিপত্যবাদ নিপাত যাক।

হ্যাঁ, হাদি বলেছিল আমাকে কেউ থামাতে পারবে না, একমাত্র বুলেট ছাড়া। আর তাইতো কাপুরুষরা বুলেট তাক করেছিল বাংলাদেশের মগজের দিকে। তারা তো বুঝল না, হাদিকে মারতে গিয়ে অমর করে রাখল। এখন অমর ওসমান হাদিকে কীভাবে মারবে? হাদি একা নন, এর আগে এই পথে হেঁটেছেন আরও অনেকে। আবরার ফাহাদ-আবু সাঈদের কাতারে যুক্ত হলেন ওসমান হাদি। গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলন, স্লোগান ও বিদ্রোহে নির্মিত এক রঙিন চরিত্র শহীদ ওসমান হাদি। অন্যদের মতো যিনি বিন্দুমাত্র ফ্যাকাশে করেননি বিদ্রোহের রংকে। দ্বিধাহীন চলার গতি হাদিকে নিয়ে এসেছিল জনতার কাতারে। ফলে তাঁর চোখেই নিরাপদ বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করেছিল বাংলার মানুষ। তাইতো জানোয়ারদের চক্রান্তের তালিকায় শীর্ষে চলে আসে তাঁর নাম। বারবার জানোয়ারদের হুমকিতেও একটু বদলায়নি হাদির মুখের শব্দ কিংবা বলার ভঙ্গি। অনেকেই প্রায় একটা কথা বলত, ‘যে দিন দেখবেন ওসমান হাদি, হাসনাত আব্দুল্লাহ আর ব্যারিস্টার ফুয়াদ বিক্রি হয়ে গেছেন, সে দিন বুঝবেন বাংলাদেশে আধিপত্যবাদের লড়াই শেষ।” পাঁচশ ভোট পেয়ে আগামী পঞ্চাশ-একশ বছরের যে রাজনীতি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন হাদি, সেটি হবে তো? আমি খুব করে চেয়েছিলাম হাদি সংসদে যাক। বিসমিল্লাহ বলে সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের অপকর্ম ও দুর্নীতি তুলে ধরুক দরাজ কণ্ঠে। গুলি লাগার পর মনস্তাত্ত্বিকভাবে মেনে নিয়েছিলাম এযাত্রায় ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও বারবার মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম অন্তত যেন নির্বাচন পর্যন্ত আমাদের মাঝে থাকেন হাদি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মগজে বুলেট নিয়ে হাদি বিজয় অর্জন করত, এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। জাতি এক বৈপ্লবিক ইতিহাসের সাক্ষী হতো। হাদি স্ট্রেচারে শুয়ে শপথ নিত। হুইল চেয়ারে বসে সংসদে চিৎকার দিয়ে বলত, “স্বাধীন বাংলাদেশ আর কখনো দিল্লির দাসত্ব করবে না।” 

কোটি কোটি টাকা ছাড়াও নির্বাচন করা যায়। নির্বাচনী খরচ মেটাতে নিঃসংকোচে হাত পেতেছেন মানুষের দরজায়। যা তাঁকে মানুষের হৃদয়ের অন্তরালে গভীরভাবে লেপ্টে দিয়েছে। জনগণের কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে জনগণের নেতা হওয়া যায়, এই ধারণা হাদিকে করেছে অনন্য। স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদি নিজেই একটি স্বতন্ত্র চরিত্র। বহু বছর পর যে চরিত্রের সাথে হৃদয় আলিঙ্গন করতে পেরেছিল সাধারণ মানুষ। মানুষের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে পারা আর সেই ভাষায় কথা বলা হাদিকে স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় করিয়েছে। মুখস্থ বয়ানে মাইক গরম করা বক্তব্য নয়, হাদি যুক্তি দিয়ে গর্জে উঠেছে বারংবার। যে যুক্তি ছুঁয়ে গেছে দেশপ্রেমিক প্রতিটি হৃদয়ে। তাই তো শুভাকাক্সক্ষী থেকে শুরু করে সমালোচক সবাই আজ হাদির অনুপস্থিতিতে দু’হাত তুলেছে রবের দরজায়। আচ্ছা, শেষ কবে এমন রাজনীতিবিদের বিদায় দেখেছেন? মনে পড়ে কারও কথা? দেশের মানুষ কখনো রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য এভাবে প্রাণ খুলে দোয়া করেনি বা চোখের পানি ফেলেনি, যেটা হাদির জন্য করেছে। হাদি সত্যি অনেক ভাগ্যবান। দীর্ঘদিনের রাজনীতির বর্ণাঢ্য জীবন তাও তো নয়। মাত্র কয়েকটা মাস। আমার তো মনে হয় হাদি সত্যিই এ যাত্রায় বেঁচে ফিরলে পঞ্চাশ বছর লাগত না, কয়েক বছরেই বদলে যেত বাংলাদেশের বস্তাপচা রাজনীতির সংস্কৃতি। কয়েক মাসের রাজনীতির জীবন প্রমাণ করে বিড়ালের মতো শত বছর বেঁচে লাভ নেই, বরং বাঘের মতো ১ ঘণ্টা বাঁচার মধ্যেই আসল পুরুষত্ব, আসল বীরত্ব। 

গুলিবিদ্ধ হাদির সুস্থতা কামনায় কেউ ছিল না পিছিয়ে। ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ার; এভারকেয়ার থেকে সিঙ্গাপুর উড়ন্ত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সাথে সারথি হয়েছিল কোটি মানুষের প্রার্থনা। খোদ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। যার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শোকাহত করেছিল রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গোটা রাষ্ট্রকাঠামোকে। কে জানত, মাথার খুলি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া হাদির জন্য সৃষ্টিকর্তা উত্তম ফয়সালা রেখেছেন শামিল করে নিলেন শহীদের কাতারে। এটাই তো হাদি চেয়েছিল; বলেছিল, ‘৫০ বছর বেঁচে কী লাভ যদি দেশের জন্য কিছু না করতে পারি, যদি মানুষের মাঝে কোনো ইমপ্যাক্ট না পড়ে।’ হাদির চাওয়া পূরণ হয়েছে; হাদির ৫০ বছর বাঁচা লাগেনি, অল্প সময়েই হাদি সেটা পেরেছে। হাদি বেঁচে থাকবে বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর আর ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহাকাব্যে।

যদি রক্ত দিয়ে গায়ের জামা ভিজে যায়, তবে ইতিহাস বদলে যাবে। হাদি চলে যায়নি; সে সাহস, আদর্শ আর দেশপ্রেমের ভাষা শিখিয়ে গেছে। বুকভরা সাহসে জন্ম নেওয়া সেই বীর আমাদের মাঝেই হাজার বছর বেঁচে থাকবে। হাদি ছিল ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বটবৃক্ষ। এই বৃক্ষ কেটে লাভ হবে না; মাটির গভীরে থাকা শিকড় থেকে বের হবে হাজারো নতুন বৃক্ষ। আর শহীদ হাদির স্বরে বলে উঠবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ! স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভ্যানগার্ড নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর শহীদ ওসমান হাদি। শহীদের প্রতি জাতির ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তবুও চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর শহীদ ওসমান হাদির কবর হোক; জ্ঞান, প্রতিবাদ আর ইতিহাসের কাছে হাদির চিরস্থায়ী উপস্থিতি থাকুক। আজ মনে পড়ছে কবি আল মাহমুদের দু’টি লাইন: ‘আমাদের গন্তব্য তো এক সোনার তোরণের দিকে যা এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই। শহীদের চেহারার কোনো ভিন্নতা নেই। আমরা তো শাহাদাতের জন্যই মায়ের উদর থেকে পৃথিবীতে পা রেখেছি।’ যে জীবন মাটির ভাষা বুঝেছে, তার থামা হয় মানুষের কণ্ঠে। শেষ অধ্যায় লেখা হয় গৌরবের অক্ষরে। ১৯৯৩ সালে জন্ম নেওয়া হাদির কোনো মৃত্যুসাল নেই। এক হাদিকে ওরা গুলি করে শহীদ করেছে, লক্ষ হাদি আসবে বাংলার মাটিতে। প্রিয় শহীদ ওসমান হাদি, তোমার রক্তধারার উত্তরসূরি বাংলার মানুষ। তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশে তোমার দর্শনের রাজনীতি বিনির্মাণ হবেই হবে। মনে রেখো দেশ, মাটি ও বাংলাদেশের মানুষ হাদির একটা ১০ মাসের সন্তান আছে।

আরও পড়ুন

লেখক 

মেহেদী হাসান নাঈম

শিক্ষার্থী

সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আধিপত্যবাদ বিরোধী কণ্ঠস্বর শহীদ ওসমান হাদি

ইমরান এবং তার স্ত্রীকে ১৭ বছর কারাবাসের সাজা দিলেন আদালত

বাংলার ওসমান হাদি যেন অটোমানের ওসমান গাজী

শত শত কামিকাজি ড্রোন কিনছে ভারত

নকলায় নিখোঁজের চারদিন পর বাড়ির পাশের পুকুর থেকে শিশুর মরদেহ উদ্ধার

ময়মনসিংহে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৭