ঢাকা ৮-এর গুলিবর্ষণ: সহিংসতার রাজনীতি আর কতকাল
বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নির্বাচন মানেই যেন আতঙ্ক, তীব্র উত্তেজনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো- বিশেষত ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সশস্ত্র হামলা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিল, রাজনীতির নামে সহিংসতা এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আজ শুক্রবার দুপুরে বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় তিনটি মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত ও দ্রুতগতির যেন একটি সুসংগঠিত বার্তা। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গুরুতর অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে তাঁর অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। এ ঘটনা শুধু একজন প্রার্থীর ওপর হামলা নয় এটি পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা, স্বাধীনতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ওপর সরাসরি আঘাত। বাংলাদেশের নির্বাচনী সহিংসতার একটি বড় কারণ হলো ট্যাগিং রাজনীতি যেখানে যাকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে হয়, তাকে আগে সামাজিকভাবে ট্যাগ করা হয় “ওরা আমাদের বিপক্ষে”, “ওরা শত্রু”, “ওরা অমুক দলের লোক”, “ওরা ষড়যন্ত্রকারী”, “ওরা বিদেশি এজেন্ট” এই ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিকে মানবিক পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, যেন রাষ্ট্রবিরোধী হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। তখন হামলা, হুমকি বা দমন এসবকে দল সমর্থকরা “ন্যায়সংগত” বলে মনে করে।
এভাবেই কথার লড়াই ধীরে ধীরে অস্ত্রের লড়াইয়ে রূপ নেয়। গণতন্ত্রে প্রতিপক্ষ থাকা স্বাভাবিক শত্রু বানানো নয়। ওসমান হাদি স্বাধীন প্রার্থী ছিলেন, কোনো বড় দলের ব্যানারে না থেকেও নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় জনপ্রিয়তা অর্জন করছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বিভিন্ন অনিয়ম ও চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছিলেন এসব কারণে তিনি সামাজিক রাজনৈতিকভাবে “বিরক্তিকর” বা “অস্বস্তিকর” ট্যাগ পেয়েছেন। রাজনীতিতে যখন যুক্তির বদলে ট্যাগিং সংস্কৃতি প্রধান হয়ে ওঠে, তখন ব্যক্তির ওপর হামলা যেন নীরবে বৈধতা পায়। প্রতিবারই আমরা দেখি একই দৃশ্য- গুলিবর্ষণ, আহত বা নিহতের খবর, পুলিশি বিবৃতি, সিসিটিভি বিশ্লেষণের আশ্বাস, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, জনমনে ক্ষোভ, কিছুদিন পরেই ভুলে যাওয়া- এ চক্রের মধ্যে থেকে যায় ভুক্তভোগী পরিবার, ভয়ে থাকা সাধারণ মানুষ আর ক্ষতিগ্রস্ত গণতন্ত্র। বিনা ভয়ে নির্বাচন করার অধিকার একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার এখন যে কতটা ভঙ্গুর, ওসমান হাদির ওপর হামলা আবারও তা প্রমাণ করে দিল। নির্বাচন যদি হয় ভয় আতঙ্কের মধ্যে, তাহলে ফল যাই হোক গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবে দুর্বল হয়। স্বাধীন প্রার্থীদের ওপর হামলা হলে রাজনীতি আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, এবং ট্যাগিং নির্ভর বিভক্তি আরও গভীর হয়।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি চায় সহিংসতা নয়। তারা ভিন্নমতকে সম্মান করে গড়ে ওঠা রাজনীতি চায়, ট্যাগিং এবং দমন-পীড়নের রাজনীতি নয়। আজ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, কাল হয়তো অন্য কেউ হবে। এই চক্র থামাতে হলে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ সবাইকে বুঝতে হবে- গণতন্ত্রে অস্ত্রের স্থান নেই; যুক্তি, বিতর্ক ও সম্মানের জায়গাই রাজনীতির প্রকৃত ভিত্তি।
লেখক
শাহারিয়া নয়ন
শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম বিভাগ
সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়
ঠিকানা: সেক্টর ৩, উওরা, ঢাকা-১২৩০
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








