দৃষ্টিদূষণ কালচার
ভোটের সিজনে পোস্টারসহ আরো কিছু উপকরণ ব্যবহার করা আমাদের দেশীয় ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছে। এসব উপকরণের যত্রতত্র ব্যবহার যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আবার এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘মনোমালিন্য’ দেখা দেয় প্রায়ই। গত ২৭ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে প্রসঙ্গটি তুলে এনে ‘দৃষ্টিদূষণ’ নামের একটি সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করা হয়। যার বাস্তবতা সত্যি। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন দলগুলিকে নির্বাচনী প্রচারণায় লাগানো পোস্টার সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের পর প্রায় দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও এর বাস্তবায়ন সেভাবে চোখে পড়ছে না।
এখনো রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর-নগর নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টারে ছেয়ে আছে। মেট্রোরেলের পিলার থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাস্তাঘাট, সড়কের আইল্যান্ড ও দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অনুরোধ উপেক্ষা করে এবং আইন ভেঙে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এর আগেই নির্বাচন কমিশন প্রচারণায় পোস্টার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নির্বাচনি আচরণবিধির গেজেট প্রকাশ করেছিল; অথচ বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলির নেতাকর্মীদের নামে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন এখনো ঝুলছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যারা খুব শিগগিরই জাতীয় সংসদে বসবেন এবং আইন প্রণয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন, সেই ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্যদেরই একাংশ প্রকাশ্যে আইন অমান্য করছেন। এমনকি একজনের পোস্টারের ওপর আরেক জনের পোস্টার লাগানো বা জায়গা দখলের প্রতিযোগিতাও লক্ষণীয়। অর্থাৎ পোস্টার সাঁটানোর সেই পুরোনো সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান।
'দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২'-এর বিধানগুলো অনুযায়ী বলা হচ্ছে- এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যেকোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে (ধারা-৪)। ধারা-৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না (ধারা-৩)। কেউ এই আইন ভাঙলে তার বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড আরোপ করা যাবে। অর্থদন্ড দিতে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ পনেরো দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড হতে পারে। এর পাশাপাশি ঐ ব্যক্তিকে তার নিজের খরচে সংশ্লিষ্ট দেওয়াল লিখন বা পোস্টার মুছে ফেলার নির্দেশও দেওয়া যাবে। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে কোনো পোস্টারই ব্যবহার করা যাবে না। এবার শুধু বিলবোর্ডে প্রচারের অনুমতি থাকবে। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, শহর-নগরের সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানেও আইন আছে; কিন্তু সেই আইনেরও সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা এবং দলের জন্য দেড় লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে তদন্ত সাপেক্ষে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও ইসির হাতে রয়েছে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি কার্যকর হবে তফসিল ঘোষণার পর থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। তফসিল ঘোষণার পরও রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা পোস্টার না সরালে, নির্বাচন কমিশন নিজেরাই তা অপসারণ করবে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন প্রয়োগ ছাড়া লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পোস্টার সরানো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। জরিমানা ও কারাদন্ডের বিধান কার্যকর করা হলে অন্যরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। এছাড়া, যে হারে পোস্টার অপসারণ চলছে, তা-ও পর্যাপ্ত নয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক এক মাসে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করেছেন। এই অপসারণে যে খরচ হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা প্রয়োজন। কেউ যাতে এই বিষয়ে দায় এড়াতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনে আইনটি সংশোধন করাও আবশ্যক। পোস্টার-ফেস্টুন, ব্যানার প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশে যেভাবে শহরের ‘দৃষ্টিদূষণ’ হচ্ছে, তা মোটেও কাম্য নয়। তাই শহর-নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সকলকে সচেতন ও সুশৃঙ্খল হতে হবে। নিজের শহর মনে করেই আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
আরও পড়ুনএটি স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং আইন প্রণয়নের পরেও মাঠ পর্যায়ে এর কার্যকর প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এটি সুষ্ঠু ও পরিবেশবান্ধব নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক
আমির খসরু সেলিম
ছড়াকার, সংবাদকর্মী
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








