ভিডিও শনিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:০০ রাত

৫-৭ দিন আগে জানা যায় ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত 

ভূমিকম্পের কাছে প্রযুক্তি এক অসহায় বাস্তবতা

মোঃ রেজাউল করিম রাজু : আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলে বা বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলে আমরা এখন আর চমকে উঠি না। স্যাটেলাইট ইমেজের কল্যাণে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার এক সপ্তাহ আগেই আমরা বাতাসের গতিবেগ, আছড়ে পড়ার সময় এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা সবই জেনে যাই। অথচ মাটির গভীরে যখন প্রলয়ংকরী শক্তি দানা বাঁধে, তখন বিশ্বের অত্যাধুনিক সেন্সরগুলোও থাকে নীরব।

গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশের ভূমিকম্প পরিস্থিতি এই প্রশ্নটিকেই নতুন করে সামনে এনেছে। ২১ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর এই সাত দিনে দেশ যেভাবে বারবার কেঁপে উঠল, তাতে প্রযুক্তির অসহায়ত্বই যেন নগ্নভাবে ফুটে উঠল। বিশেষ করে ২১ নভেম্বরের ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর ২২ নভেম্বর সকাল ১০টায় আবারও কম্পন এবং একই দিন সন্ধ্যা ৬টায় ‘ডাবল জোল্ট’ বা জোড়া আঘাত এই ঘটনাগুলো প্রযুক্তি আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি কেন?

আবহাওয়ার পূর্বাভাস বনাম ভূমিকম্পের অন্ধকার : প্রথমেই বোঝা দরকার, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের বিজ্ঞানের মৌলিক পার্থক্য কোথায়। আবহাওয়া বা ঘূর্ণিঝড় হলো ‘অ্যাটমোস্ফিয়ারিক’ বা বায়ুমণ্ডলীয় ঘটনা। স্যাটেলাইট দিয়ে ওপর থেকে মেঘের গতিবিধি এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন রিয়েল টাইমে দেখা যায়। সুপারকম্পিউটার সেই ডেটা বিশ্লেষণ করে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে।

কিন্তু ভূমিকম্প হলো ‘জিওলজিক্যাল’ বা ভূতাত্ত্বিক ঘটনা। এটি ঘটে মাটির ১০ থেকে ৫০ কিলোমিটার নিচে, যেখানে কোনো ক্যামেরা বা স্যাটেলাইট পৌঁছাতে পারে না। টেকটনিক প্লেটের ঘর্ষণ বা শিলাচ্যুতির প্রক্রিয়াটি ‘নন-লিনিয়ার’ এবং ‘কেওটিক’ (বিশৃঙ্খলাপূর্ণ)। এখানে ১ প্লাস ১ সব সময় ২ হয় না। তাই মাটির নিচে ঠিক কখন চ্যুতি ঘটবে, তা গণনা করার মতো কোনো অ্যালগরিদম আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি।

২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কম্পন : গত ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর, ২২ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে আবারও কম্পন অনুভূত হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি ‘প্যাটার্ন’ মনে হলেও, সিসমোলজিক্যাল প্রযুক্তির কাছে এটি ছিল আকস্মিক।

আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি ‘প্রেডিকশন’ (আগাম ভবিষ্যৎবাণী) করতে পারে না, পারে কেবল ‘ডিটেকশন’ (শনাক্তকরণ)। অর্থাৎ, ঘটনা ঘটার পর আমরা জানতে পারি। ২২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ০৬ মিনিটে যে ‘ডাবল জোল্ট’ বা পরপর দুবার কম্পন হলো, সেখানেও প্রযুক্তির একটি বড় সীমাবদ্ধতা দেখা গেছে। স্মার্টফোনের অ্যান্ড্রয়েড অ্যালার্ট সিস্টেম প্রথম কম্পনটি শনাক্ত করে প্রসেস করতে করতেই দ্বিতীয় কম্পনটি আঘাত হানে। ফলে সার্ভার থেকে ব্যবহারকারীর ফোনে সতর্কবার্তা পৌঁছানোর আগেই মাটি কেঁপে ওঠে।

ঢাকার বড় বিপদ : কেন আমরা অ্যালার্ট পাই না? এর কারিগরি উত্তর হলো ‘ব্লাইন্ড জোন’।

ভূমিকম্পের সময় দুই ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয় দ্রুতগামী ‘পি-ওয়েভ’ (যা ক্ষতি করে না) এবং ধ্বংসাত্মক ‘এস-ওয়েভ’। আধুনিক আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের কাজ হলো পি-ওয়েভ শনাক্ত করে এস-ওয়েভ আসার আগে সংকেত পাঠানো।

কিন্তু সমস্যা হলো, গত সপ্তাহের ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকার আশেপাশের ফল্টলাইন। উৎপত্তিস্থল যখন শহরের এত কাছে থাকে, তখন পি-ওয়েভ এবং এস-ওয়েভ প্রায় একই সময়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায়। ডেটা প্রসেস করে সংকেত পাঠাতে প্রযুক্তির যে ২-৩ সেকেন্ড সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যেই কম্পন শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, উৎপত্তিস্থল ঢাকার ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে, বিশ্বের কোনো প্রযুক্তই ঢাকাবাসীকে আগাম সতর্ক করতে পারবে না। একেই বলা হয় প্রযুক্তির ‘ব্লাইন্ড জোন’।

গুগল অ্যালার্ট কি তবে মিথ্যা? : অনেকের ফোনে ‘গুগল আর্থকোয়েক অ্যালার্ট’ আসে, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় কম্পন থামার পর নোটিফিকেশন এসেছে। এর কারণ, গুগল কোনো মাটির নিচের সেন্সর ব্যবহার করে না। এটি কোটি কোটি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ‘এক্সিলালোমিটার’ ব্যবহার করে। যখন হাজার হাজার ফোন একই সময়ে নড়ে ওঠে, গুগল সার্ভার সেটাকে ভূমিকম্প হিসেবে ধরে নেয় এবং বাকিদের জানায়। এটি একটি ‘ক্রাউড সোর্সড’ প্রযুক্তি। গত ২৭ নভেম্বর তিনবার কম্পনের সময় এই সিস্টেমটি কাজ করলেও, তা ছিল ‘রিয়েল টাইম রেসপন্স’, কোনোভাবেই ‘আগাম বার্তা’ নয়।

তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিক হিসেবে বিশ্লেষণ শেষে এ কথা বলতেই হয় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমরা এক অদ্ভুত প্রযুক্তিবৈষম্যের শিকার। মহাকাশের নক্ষত্রের মৃত্যু আমরা টেলিস্কোপে আগে থেকে দেখতে পাই, কিন্তু পায়ের নিচের মাটির খবর আমরা রাখি না।

ভবিষ্যতে হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মাটির নিচের লক্ষ লক্ষ বছরের ডেটা বিশ্লেষণ করে কোনো প্যাটার্ন বের করতে পারবে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা প্রযুক্তির নেই। গত সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বা সন্ধ্যার জোড়া আঘাত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমাদের তাকাতে হবে বাড়ির বিম ও কলামের দিকে। কারণ, ভূমিকম্পে প্রযুক্তি আপনাকে তথ্য দিতে পারবে, কিন্তু বাঁচাতে পারবে কেবল সঠিক প্রকৌশল। যে কোনো মতামত, তথ্য বা প্রতিক্রিয়ার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন :  rajuitnews@gmail.com

 

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভূমিকম্পের কাছে প্রযুক্তি এক অসহায় বাস্তবতা

অনলাইন কেনাকাটায় নতুন বিপ্লব: ক্রেতাদের ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে আসছে এআই

ইউটিউবে আসছে ‘কাস্টম ফিড’: হোমপেজে নিজের পছন্দমতো ভিডিও দেখার দারুণ সুবিধা

চ্যাটজিপিটিতে এবার ‘গ্রুপ চ্যাট’ সুবিধা: একসঙ্গে ২০ জনের কথোপকথনের সুযোগ

খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানালেন মঈন খান

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা একদমই ভালো না: আসিফ নজরুল