বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ: ঘরে বসেই বিপ্লব
একটা সময় ছিল যখন সকালের আলোয় মেয়েরা জানালার পাশে বসে সেলাই করতো, আর বিকেলে সেই হাতেই উঠতো হাঁড়ি। জীবন ছিল সীমাবদ্ধ, অথচ তাতে ছিল তৃপ্তির সাথে কিছু অপূর্ণতার দীর্ঘশ্বাস। নারীরা তখন সংসারের চাকা ঘুরাতো, কিন্তু অর্থনীতির চাবি ছিল অন্যের হাতে। যেন ফুল আছে কিন্তু সুবাস অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে। আজ দৃশ্যটা বদলে গেছে। ঘরের কোণে থাকা সেই সেলাই মেশিনের পাশে এখন একটি স্মার্ট ফোন রাখা। সেই ফোনেই চলে পণ্য বিক্রির পোস্ট, অর্ডার ম্যানেজমেন্ট আর গ্রাহকের সাথে কথা। ঘরের কাজ আর ব্যবসার হিসাব দুটোই চলছে পাশাপাশি। নারী আর শুধু সংসারের রাঁধুনি নন, তিনি এখন নিজের ব্যবসার পরিচালক। এ যেন এক নিঃশব্দ বিপ্লব যেখানে কোনো রক্তপাত নেই তবু সমাজ কেঁপে উঠছে এই নতুন ক্ষমতায়নের সুরে। ঘরের চৌহদ্দির ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন অর্থনীতি, যা ঘরে বসেই বিপ্লব। বাণিজ্য সবসময়ই ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। যার হাতে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই সমাজের প্রভাব। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই জায়গাটা ছিল পুরুষ নির্ভর। নারীরা ছিল সহায় কিন্তু অংশীদার নয়। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ডিজিটাল যোগাযোগ এই প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। আজ এক মোবাইল ফোনই ব্যবসার অফিস,এক ফেসবুক পেজই দোকান, আর এক মোবাইল ব্যাংক একাউন্টই পুরো লেনদেনের মাধ্যম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন যেন এক সামাজিক রেঁনেসা। গত এক দশকে দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে নিবন্ধিত নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখেরও বেশি যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঘরে বসে ব্যবসা পরিচালনা করেন। একসময় যে নারীরা সমাজে নিজেদের স্থান খুঁজে পেতে লড়তেন, তারা এখন নিজেদের হাতে গড়ে তুলছেন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য, ছোট হোক বা বড়, কিন্তু নিজের। এক প্রতিবেদনে লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশে ফেসবুক ভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখের বেশি আর এদের মধ্যে প্রায় ৭০% নারী ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এদের অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে এবং শিক্ষা, চাকরি, মাতৃত্ব বা পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ঘরে বসে এই পথ বেছে নিয়েছেন। এই বিপ্লবের মূলে আছে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ। ইন্টারনেট, স্মার্টফোন আর অনলাইন পেমেন্ট সেবা নারীদের জন্য ব্যবসা পরিচালনাকে সহজ করে তুলেছে। ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ নারীকে স্বাধীন সময় বন্টনের ক্ষমতা দিয়েছে। সন্তান, পরিবার আর ব্যবসা সবকিছু এখন একসাথে সামলানো সম্ভব। নারীরা আজ বুঝেছেন নিজের আয় মানেই নিজের মর্যাদা। এই উপলব্ধিই তাদেরকে উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করেছে। এছাড়াও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি প্রকল্প উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এখন সমাজ ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছে যে নারী শুধু সংসারের নয়, রাষ্ট্রের অর্থনীতিরও চালিকাশক্তি হতে পারে। তবে সব পরিবর্তনের পথেই কিছু বাধা থাকে। অনেক নারী এখনো ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন সিকিউরিটি এসব ব্যবস্থাপনা জানেন না। আবার, অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন মেয়েরা ব্যবসা করতে পারে না। অনেক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। অনলাইন ব্যবসায় নারীরা প্রায়ই অবমাননাকর মন্তব্য, প্রতারণা এমনকি অননুমোদিত ছবি ব্যবহারের শিকার হন। আর,বড় কোম্পানি বা ব্রান্ডের সাথে প্রতিযোগিতা করা ছোট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ, মাতৃভাষাভিত্তিক ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা উচিত। সাইবার অপরাধ দমন ও অনলাইন প্রতারণা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পাশাপাশি, পরিবারগুলোকে বুঝতে হবে নারী সাফল্য মানেই পরিবারের সাফল্য। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কর ছাড়, সহজ ঋণ ও প্রযুক্তি সহায়তা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ মানে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, এটি নারীর নিজস্ব অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারের এক আন্দোলন। যে সমাজে নারী স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে, সেই সমাজেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। এই বিপ্লব হয়তো নিঃশব্দ কিন্তু এটি সামাজিক কাঠামোর গভীরে পরিবর্তন আনছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এই বিপ্লব যেন শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। গ্রামের নারীরাও যেন একইভাবে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সুবিধা পান।
লেখক
আরমীন আমীন ঐশী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








