ভিডিও শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

আজ মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন

ছবি : সংগৃহীত,বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন

নাসিমা সুলতানা ছুটু: হাতে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে নোংরা কিছু লেগে নাপাক হয়েছে হাত ও শরীরের বিভিন্ন স্থান এমনটাই সারাক্ষণ মনে হয় গৃহিণী সেলিনার (ছদ্মনাম)। তেত্রিশ বছর বয়সী সেলিনা তাই বারবার বেসিনে ছুটে গিয়ে হাত ধোন এবং দিনে সাত-আটবার গোসল করেন। গত এক বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। নাপাকের এই চিন্তাটি সেলিনার মনের অজান্তেই চলে আসছে। ইদানিং থালা বাসন পরিস্কার করতেও বেশ সময় লাগছে। দিনে দিনে অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে, নিজের বিছানায় কাউকে বসতে দিতেও বোধহয় তার আপত্তি।

আর এগুলো কারণে পরিবারের মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকছে।  এমনকি কিছুদিন ধরে তার মনের বিরুদ্ধে, তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সৃষ্টিকর্তা ও তার ধর্মের বিপক্ষে কিছু চিন্তাও মনের ভিতরে আসছে। প্রথমদিকে পরিবারের লোকজন এটাকে ছুঁচিগ্রস্থতা ভাবলেও এখন ধর্মীয়সহ বেশ কিছু বিষয় চলে আসায় তকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক সবকিছু শুনে বললেন, এটি একটি মানসিক রোগ, যার নাম ওসিডি। চিকিৎসা শুরু করার পরে শুরুতে তেমন কিছু উন্নতি না হলেও প্রায় ছয় মাস পর তার বেশ উন্নতি হওয়া শুরু করেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়া (ছদ্মনাম) বেশ কিছুদিন থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগ বসাতে পারছিলেন না। শুধু তাই নয়, কোন কারন ছাড়াই মনের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে অশান্তি, ঘুমের সমস্যা, অশান্তি লাগা সমস্যায় ভুগছিলেন। একসময় রিয়ার মনে হতে লাগলো তাকে দিয়ে আর পড়াশোনা হবে না, ভবিষ্যতে সে আর কিছু করতে পারবে না।  এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।  আত্মহত্যাই বুঝি সমাধান।

তার মা-বাবা তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। তিনি রোগীর সাথে কথা বলে ও প্রয়োজনীয়  কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন রিয়ার গুরুতর বিষন্নতা রোগ বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার হয়েছে। কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর রিয়ার অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো হতে লাগলো। তার মনে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। মনের অস্থিরতা অশান্তিও দূর হয়ে গেল। 

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবরারের ঘটনা কিছুটা ভিন্ন। এখনকার আর সব শিশুদের মতই আবরার সারাদিন মোবাইল নিয়ে থাকতে চায়। বাবা-মা খেয়াল করলেন ইদানিং ছেলের মাঝে এক ধরণের পরিবর্তন এসেছে। বাবা মা এবং শিক্ষকদের কথা শুনতে চাচ্ছে না। রাগ, জেদ ইদানিং বেড়ে গেছে। পড়াশোনার রেজাল্ট ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে।  রাত জেগে মোবাইল দেখছে সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হচ্ছে। প্রায়ই স্কুল মিস হচ্ছে।  বাবা মা জিজ্ঞেস করায় সে বলে রাত জেগে ফ্রী ফায়ার গেমস খেলছে। মা বাবা অনেক চিন্তার পর আবরারকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।  চিকিৎসক সবকিছু শুনে বললেন তার মোবাইল বা ইন্টারনেট অ্যাডিকশন রোগ হয়েছে। 

সেলিনা, রিয়া এবং আবরারের মত এরকম অসংখ্য মানসিক রোগী বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যা বহির্বিভাগে আসছেন। 
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০/৭০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, ওসিডি, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক ডিসঅর্ডার, গাজা-মদ-ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্তি, সেক্সচুয়াল সমস্যা, বাচ্চাদের এডিএইচডি, কন্ডাক্ট  ডিসওর্ডারের রোগী প্রতিদিনই আসছেন। ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মারুফুল হক। তিনি বলেন, শুধু শজিমেক হাসপাতালেই নয় একই চিত্র টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রাফাত উল্লাহ হাসপাতালের মনোরগ বিদ্যা বহির্বিভাগেরও। 

বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে বা মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লড়াই করছে। ২০২৪ মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেপিয়েন ল্যাবসের ‘মেন্টাল স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন-২০২৩’ শীর্ষক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭১টি দেশের ১৩টি ভাষার মোট ৫ লাখ মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে তারা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, জরিপে স্থান পাওয়া বিশ্বের ৭১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩। আর বাংলাদেশের মেন্টাল হেলথ কোশেন্ট বা এমএইচকিউ স্কোর ৬২। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে বা মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লড়াই করছে।

আরও পড়ুন

এছাড়া ওই বছর বাংলাদেশের এক সংস্থার করা আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ বিষন্নতা, ৫৯.৭ শতাংশ মানসিক চাপ, ৩৩.৭ শতাংশ উদ্বিগ্নতায় ভুগছে। শহরে বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের মাঝে ৩৬.৬ শতাংশ বিষন্নতায় ভুগছে। যার মধ্যে ৪২.৯ শতাংশ মেয়ে ও ২৫.৭ শতাংশ ছেলে। শিশুদের মাঝে ১২.৬ শতাংশ বিভিন্ন রকম মানসিক রোগে ভুগছে। এদের মাঝে ১৩.৭ শতাংশ ছেলে ও ১১.৫ শতাংশ মেয়েশিশু। 

দীর্ঘদিনের বিষন্নতা থেকে যখন মুক্তি মেলে না, তখন তা মানসিক রোগে পরিণত হয়। গবেষণা বলছে, জীবনে হতাশা, নিঃসঙ্গতা থেকে দেশে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। 

মন খারাপ, ভালো লাগে না, মুড অফ কিংবা শরীর খারাপ মন সমস্যা যেন এখন নিত্যসঙ্গী। কখনো মনে হয় হাত-পা জ্বালাপোড়া করছে, আবার কখনো মনে হয় বুকে ব্যথা করছে। মনে হয় এবার মরেই যাব। মানুষের এমন মনে হওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বিষন্নতা বলা হয়।

দীর্ঘমেয়াদি এ বিষন্নতাই ডেকে আনে মানসিক সমস্যা। ব্যস্তময় জীবন আর প্রতিযোগিতার চাপে নিঃসঙ্গতা যখন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে তখনই মানসিক রোগের শিকার হন মানুষ। এ মানসিক রোগই এক সময় হয়ে ওঠে নানা শারীরিক সমস্যার কারণ। 
চিকিৎসকরা বলছেন, বিষন্নতা দু’সপ্তাহ স্থায়ী হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। এ অবস্থায় কাউন্সিলিং খুব জরুরি। কিন্তু মানসিক রোগের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় এ সেবা নিতে পারেন না বেশিরভাগ রোগী। 

ডা. মারুফুল হক বলেন, মানসিক রোগ বা বিষন্ননতা রোগে যারা ভোগেন তাদের মধ্যে হঠাৎ করে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন দীর্ঘ সময় মন খারাপ থাকা, ঘুম কমে যাওয়া, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া, খাবারে অরুচি, ভালো কিছু শুনলেও ভালো না লাগা ইত্যাদি। এসব সমস্যার চিকিৎসা না করা হলে তা আরও বাড়তে শুরু করে। যা আত্মহত্যা করার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই সাইকিয়াট্রি বা সাইকোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলে ও প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং নিলে পুরোপুরি ভালো হওয়া সম্ভব।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভিডিও বানানোর নামে হাত ধরছে, এটা কি ব্যবসা?’ | Agargaon Cake | Daily Karatoa

কিছু উপদেষ্টার থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে সতর্ক থাকতে বললেন মিয়া গোলাম পরওয়ার | PR | Daily Karatoa

বাংলাদেশিদের সমাবেশে নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র প্রার্থী মামদানি

বাংলাদেশ-বাহরাইন বৈঠক: শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার আহ্বান

লিসবনে প্রবাসীদের উৎসব, দূর দেশে আপনজন

কেক পট্টিখ্যাত আগারগাঁওয়ে চলছে পুলিশের অভিযান । cake | Daily Karatoa