পাচার হওয়া অর্থ

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকারীর মধ্যে আছে অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অপরাধ জগতের কুশীলবরা। ব্যাংক ঋণ নিয়ে লোপাট করতে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিদেশে। জাল কাগজপত্রে মর্টগেজ ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়ে তা লোপাট করা দেশের ব্যাংকিং খাতের মরণ ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানি-রপ্তানির এলসি খুলে বাস্তবে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করার কথা তা না করে বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ পাচার ঘটেছে পতিত সরকারের সময়ে।
পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমস। পত্রিকাটির নতুন প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’স মিনিং বিলিয়নস: স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ শিরোনামের এই অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারিতে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন-কীভাবে এত বিপুল অর্থ বিদেশে চলে গেলও আদৌ তা ফেরত আনা সম্ভব হবে কি না।
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা সরকার বিতর্কিত কোটা সংস্কার প্রস্তাব আনে, যা আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয় স্বজনকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার অভিযোগে ছাত্র সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। শুরু হয় দেশব্যাপী বিক্ষোভ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছাত্র জনতার নেতৃত্ব। শুরু হয় পুলিশের দমন-পীড়ন। আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ ও সরকারি বাহিনী গুলি চালায়, স্নাইপার ব্যবহার করে এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও শেল নিক্ষেপ করে।
পরিস্থিতির মোড় ঘোরে ৫ আগস্ট। ওই দিন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। জাতিসংঘের হিসাবে, এ আন্দোলনে অন্তত ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। হাজারো মানুষ আহত বা নিখোঁজ হন। দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ ছিল। বিশেষত বৃটেন হয়ে ওঠে এই পাচারের প্রধান কেন্দ্র।
আরও পড়ুনলন্ডনের শক্তিশালী আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট বাজারকে টার্গেট করে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অন্তত ১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে। ব্যাংক খাত সচল রাখতে সরকার এরই মধ্যে ২৯ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটায়।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে পাচারকারীদের প্রতি কঠোর মনোভাব থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। অর্থ পাচারকারী তো বটেই পাশাপাশি এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে এ খাতে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে অর্থ পাচার রোধে যা যা করা দরকার, তার সবই করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন সহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে তৎপর হতে হবে বলে মনে করি আমরা। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও তদন্তে দিতে হবে অধিক গুরুত্ব। আর যারা এর তদন্তে থাকবেন, স্বচ্ছতার স্বার্থে তাদেরও জবাবদিহির আওতায় রাখতে হবে। অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে সরকার আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে- এটাই প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন