পুলিশ সুপারের প্রেস ব্রিফিং
নাটোরে চিকিৎসককে গলা কেটে হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন, প্রেমের সম্পর্ক ও চাকরিচ্যুত করার ক্ষোভ

নাটোর প্রতিনিধি : নাটোরে বিএমএর আহবায়ক ডা. আমিরুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। আলোচিত এ হত্যাকান্ডে তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) মোঃ আসাদুল ইসলাম আসাদ ও ৩ নার্সসহ ৬ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যার প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসে। মূলত হাসপাতালের একজন নার্সের সাথে ত্রি-মুখি প্রেমের সম্পর্কের জের এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় জনসেবা হাসপাতালের মালিক ডা. এ এইচ এম আমিরুল ইসলামকে।
ঘটনার দিন চাকরিচ্যুত তার ব্যক্তিগত সহকারী আসাদুল ইসলাম আসাদ বোরকা ও হাতে চুড়ি পরে ফিল্মি স্টাইলে হাসপাতালে প্রবেশ করে ডাক্তারের নিজ কক্ষের খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। পরে গভীর রাতে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে ডা. আমিরুল ইসলামকে। একই সাথে তার গোপনাঙ্গও কেটে ফেলে মৃত্যু নিশ্চিত করে ভোর সোয়া ৬টার দিকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান আসাদ। যাওয়ার পথে তার ব্যবহৃত বোরকাটি সিংড়া আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এলাকার নদীতে এবং দুটি ছুরি নন্দীগ্রাম এলাকায় ফেলে দেন খুনি আসাদ।
আজ মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে নিহত চিকিৎসকের জনসেবা হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান নাটোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন। উপস্থিত ছিলেন জেলার পিবিআই পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর (সার্কেল) মাহমুদা শারমিন নেলি, সদর থানার ওসি মোঃ মাহবুর রহমান, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মোঃ হাসিবুল্লাহ হাসিবসহ আরো অনেকে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার পর থেকে তথ্য ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় যৌথভাবে কাজ করার এক পর্যায়ে হাসপাতালের স্টাফ আসাদুল ইসলাম আসাদকে মূল আসামি হিসেবে শনাক্ত করা হয়। আসাদ বগুড়ার ধুনট উপজেলার বাসিন্দা। ২০২৪ সালে এসএসসি পাসের পর তিনি টিএমএসএস মেডিকেলে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পরে নাটোরে ডা. আমিরুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) হিসেবে তিন বছর ধরে কর্মরত ছিলেন জনসেবা হাসপাতালে।
কর্মরত অবস্থায় হাসপাতালের এক নারী সেবিকার সাথে সম্পর্ককে ঘিরে ডা. আমিরুল, ওই নারী এবং আসাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই দ্বন্দ্বের জেরে এক পর্যায়ে গত ২৫ আগস্ট ডা. আমিরুল ওই নারী সেবিকা (নার্স) এবং আসাদকে মারধর করেন। একই সঙ্গে চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করেন। এরপর আসাদ বগুড়ায় ফিরে গেলেও তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম হয়। প্রতিশোধ নিতে তিনি বগুড়া থেকে একটি বোরকা ও দুটি ছুরি কিনে ফের নাটোরে ফিরে আসেন। এরপর গত ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় বোরকা ও হাতে চুড়ি পড়ে আসাদ জনসেবা হাসপাতালে প্রবেশ করেন।
আরও পড়ুনপরে ডা. আমিরুল ইসলামের চেম্বারের কক্ষে প্রবেশ করেন এবং ওই কক্ষের খাটের নিচে লুকিয়ে থাকেন। রাত ১টার দিকে ডাক্তার নিজের কক্ষে ফিরে আসেন এবং ওষুধ সেবন শেষে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে গভীর ঘুমের মধ্যে থাকা ডা. আমিরুলের ওপর আসাদ ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাকে গলা কেটে হত্যাসহ গোপনাঙ্গ কেটে ফেলেন। পরে ভোর সোয়া ৬টার দিকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান আসাদ। যাওয়ার পথে তিনি বোরকাটি সিংড়া আইসিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এলাকার নদীতে এবং দুটি ছুরি বগুড়ার নন্দীগ্রাম এলাকায় ফেলে দেন।
পুুলিশ সুপার বলেন, নিজের প্রেমিকার সাথে ডা. আমিরুল ইসলাম অবৈধ সর্ম্পকে জড়িয়ে পড়া এবং সেটা জানাজানি হওয়ার পর আসাদুলকে তাড়িয়ে দেয়ার ক্ষোভ থেকেই পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে আসাদুল স্বীকার করেন। দ্রুত আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন বলেও পুলিশকে নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত দুটি ছুরি নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সিংড়া উপজেলার শেরকোল নিঙ্গইন আইসিটি পার্ক এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে।
আসাদুলের ব্যবহৃত বোরখাটি সিংড়ার আত্রাই নদীতে ফেলে দেয়ায় এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে আজ মঙ্গলবার আছরের নামাজের পর নাটোর পৌরসভার ঈদগাহ মাঠে নামাজে জানাজা শেষে স্থানীয় গাড়ীখানা কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতেই নিহত চিকিৎসক ডা. এ এইচ এম আমিরুল ইসলামের সহধর্মিনী তাসমিন সুলতানা বাদি হয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগে নাটোর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
অপরদিকে ডা. আমিরুল হত্যার প্রতিবাদে কালোব্যাজ ধারণ করেছেন চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তারা সকাল থেকে কালো ব্যাজ ধারণ করে এ ঘটনার শোক প্রকাশ করেন।
মন্তব্য করুন