ভিডিও মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫

ভারতে গারবেজ ক্যাফের চল

টাকার বদলে ‘আবর্জনা’ জমা দিলেই খাবার মেলে যেখানে

ছবি : সংগৃহীত,টাকার বদলে ‘আবর্জনা’ জমা দিলেই খাবার মেলে যেখানে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : টাকার বদলে প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, খাবারের মোড়ক ইত্যাদি দিয়ে খাবার মেলে এমন ক্যাফে হয়তো শুনতে অবিশ্বাস্য, কিন্তু ভারতের ছত্তিশগড়ের অম্বিকাপুর শহর সেটাকেই প্রতিদিনের বাস্তবতায় পরিণত করেছে। তাছাড়া ধীরে ধীরে ভারতজুড়ে এই ‘গারবেজ ক্যাফে’র চল দেখা যাচ্ছে।

অম্বিকাপুরের গারবেজ ক্যাফেটিতে এক কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ভরপেট খাবার, আর আধা কেজি প্লাস্টিকের বদলে সিঙ্গারা কিংবা বড়া পাভ পাওয়া যায়। ‘মোর দ্য ওয়েস্ট, বেটার দ্য টেস্ট’- এই স্লোগান নিয়ে ২০১৯ সালে শুরু হওয়া গারবেজ ক্যাফে শুধু ক্ষুধার সমাধান করেনি, একইসঙ্গে শহরকে করেছে পরিচ্ছন্ন।

অম্বিকাপুর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের (এএমসি) উদ্যোগে প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন মানুষ খাবার পান এখানে। প্লাস্টিক জমা দেওয়া সেই বর্জ্য আলাদা করে রিসাইকেল হয়, কখনো রাস্তা তৈরিতে কাজে লাগে, কখনো বিক্রি হয়ে ফের অর্থ ফেরে সরকারি খাতায়।

এএমসি’র পক্ষ থেকে এই ক্যাফে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিনোদ কুমার প্যাটেল। তিনি জানিয়েছেন, এক কেজি প্লাস্টিক বর্জ্যর পরিবর্তে একজন ভরপেট খাবার পেতে পারেন। সেখানে থাকে দু’রকমের তরকারি, ডাল, রুটি, সালাদ ও আচার। আর আধা কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে তারা জলখাবার পান, যেমন সিঙ্গারা বা বড়া পাও।


এই শহরে দৈনিক ৪৫ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এককালে এখান থেকে ৩.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১৬ একর বিস্তৃত ডাম্পিং গ্রাউন্ডে আবর্জনা ফেলা হতো। বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ফেলা নিয়ে হিমশিমও খেতে হয়েছিল। তবে ২০১৬ সালে এএমসি ওই ডাম্পিং গ্রাউন্ডকে পার্কে রূপান্তরিত করে। ‘জিরো-ওয়েস্ট ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম’ বা শূন্য-বর্জ্য বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা চালু করা হয় যাতে এই জাতীয় ডাম্পিং গ্রাউন্ডের দরকারই না পড়ে।

সংগৃহীত প্লাস্টিক রিসাইকেল করে ছোট ছোট গ্র্যানিউল বা দানা তৈরি করা হয় যা রাস্তা নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হয়। অথবা সেগুলো রিসাইক্লারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় যেখান থেকে স্থানীয় সরকারি খাতায় অর্থ আসে।

২০২০ সালের সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, ‘ওয়েট ওয়েস্ট’ বা ভেজা বর্জ্যকে কম্পোস্ট করা হয় এবং যে অল্প পরিমাণ বর্জ্যকে রিসাইকেল করা যায় না সেগুলোকে জ্বালানির জন্য সিমেন্ট কারখানায় পাঠানো হয়। এই প্রচেষ্টার হাত ধরেই অম্বিকাপুর এখন ‘জিরো ল্যান্ডফিল সিটি’ (যে শহরে বর্জ্য মাটিতে স্তূপ হয় না) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।


গারবেজ ক্যাফেতে আসা প্লাস্টিক এএমসি পরিচালিত স্থানীয় বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। অম্বিকাপুরে এখন ২০টা বিকেন্দ্রীভূত কেন্দ্র রয়েছে যেখানে সংগ্রহ করার পর বর্জ্যকে বাছাই করার সময় ৬০টিরও বেশি ভাগে ভাগ করা হয় যাতে সর্বাধিক পরিমাণে রিসাইক্লিং সম্ভব হয়।

এই কেন্দ্রগুলোতে ৪৮০ জন নারী নিয়োগ করা হয়েছে যাদের যাদের ‘স্বচ্ছতা দিদি’ বলে সম্বোধন করা হয়। তারা এই সেন্টারগুলোতে বর্জ্য পৃথকীকরণের পাশাপাশি প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহস্থালির আবর্জনাও সংগ্রহ করেন। এই কাজ করে মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা আয় করেন তারা।

রশ্মি মণ্ডলের মতো বাসিন্দাদের কাছে এই ক্যাফে যেন আশীর্বাদ। একসময় যেই প্লাস্টিক বর্জ্য কেজি প্রতি দশ টাকায় বেচতে হতো, এখন তাই পরিবারের জন্য খাবারের নিশ্চয়তা হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

আমি বহু বছর ধরে এই কাজ করছি, নিজের সংগ্রহ করা ছোট্ট প্লাস্টিকের স্তূপের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রশ্মি মণ্ডল। এর আগে, তার সংগ্রহ করা প্লাস্টিক বর্জ্য স্থানীয় স্ক্র্যাপ ডিলারদের কাছে কিলোগ্রামপ্রতি মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি করতেন, যা জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।

তিনি বলেছেন, কিন্তু এখন যে প্লাস্টিক সংগ্রহ করছি তার বদলে বাড়ির লোকের জন্য খাবার কিনতে পারছি। এটা আমাদের জীবনে একটা বড় বদল এনেছে।

ভারত সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন আরবান’র আওতায় অম্বিকাপুরের স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা রীতেশ সাইনি জানিয়েছেন, এই ক্যাফে শহরের প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণের ওপরও প্রভাব ফেলেছে।

অম্বিকাপুর আজ ভারতের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহর। ২০১৬ সালে যেই ডাম্পিং গ্রাউন্ড শহরের মাথাব্যথা ছিল, সেটি আজ রূপান্তরিত হয়েছে পার্কে। শহর অর্জন করেছে ‘জিরো ল্যান্ডফিল সিটি’র খেতাব।

তবে সব গল্প যে নিখুঁত, তা নয়। মৌলিক সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকায় ঝুঁকি থেকে যায় বর্জ্য সংগ্রাহকদের জীবনে। পরিবেশবিদ মিনাল পাঠকের মতে, গারবেজ ক্যাফে মূল সমস্যার পুরো সমাধান নয়, বরং ‘ভাসা ভাসা একটা সমাধান’। তবু এই উদ্যোগ সচেতনতা তৈরি করেছে, স্থানীয় সমাধান হিসেবে কাজ করছে।

এদিকে, এই মডেল এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। শিলিগুড়ি, মুলুগু, মাইসুরু, এমনকি উত্তরপ্রদেশেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেখা যাচ্ছে। কোথাও প্লাস্টিকের বিনিময়ে চাল, কোথাও স্যানিটারি প্যাড, আবার কোথাও ক্যান্টিনে খাবার। ভারত ছাড়িয়ে কম্বোডিয়ার টনলে স্যাপ লেকের তীরেও একই রকম প্রয়াস দেখা গেছে।

অম্বিকাপুরের গল্প তাই শুধু প্লাস্টিক বা ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং দেখিয়ে দিয়েছে স্থানীয় স্তরে ইচ্ছাশক্তি থাকলে সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব। সিঙ্গারার গন্ধে ভরা সেই সকাল যেন স্মরণ করিয়ে দেয়- আবর্জনা থেকেও জন্ম নিতে পারে এক টুকরো আশা।

সূত্র: বিবিসি

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ৬ লাখ টাকাসহ বিকাশ কর্মী নিখোঁজ

ডাকসু নির্বাচনে পোস্টার-ব্যানার নিয়ে কঠোর নির্দেশনা

কুড়িগ্রামের উলিপুর পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেফতার

যন্ত্র যখন যন্ত্রণাদায়ক

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে সাত কেজি বিস্ফোরক সদৃশ বস্তু উদ্ধার

লালমনিরহাটে পোস্ট পেইড মিটারের দাবিতে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও