ভিডিও রবিবার, ০৪ মে ২০২৫

শেখ হাসিনার অপশাসন নিয়ে আল জাজিরার বিশেষ তথ্যচিত্র

শেখ হাসিনার অপশাসন নিয়ে আল জাজিরার বিশেষ তথ্যচিত্র

করতোয়া ডেস্ক : শেখ হাসিনার পতন এবং পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে একটি বিশেষ তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামানসহ হাসিনা আমলের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তথ্যচিত্রে উঠে আসে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

শুক্রবার প্রকাশিত ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি আফটার শেখ হাসিনা’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্রে ফুটে উঠেছে ১৫ বছর পুলিশ, র‍্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে কীভাবে খুন, গুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী মত ও চিন্তাশক্তিকে দমন করা হয়েছিল। এছাড়াও উঠে এসেছে কীভাবে ফ্যাসিবাদের ইতিহাস রচনা করেছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন ছেড়ে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরে জনতা তার সেই বাসভবনে হামলা চালায়, যেখানে তিনি একজন নিরঙ্কুশ রাজার মতো বাংলাদেশ শাসন করতেন।

মূলত জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভের মাধ্যমে এই আন্দোলন শুরু। কিন্তু একপর্যায়ে গণগ্রেফতার, নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর শেখ হাসিনাকে উৎখাতের জন্য সেই আন্দোলন দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তথ্যচিত্রে বলা হয়, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জেন জির বেশিরভাগের কাছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকলেও অনেক অভিভাবকের কাছে তিনি ছিলেন ট্রাজিক নায়িকা। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি। তিনি ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এর চার বছর পর শেখ হাসিনার ইউরোপর সফরের সময় তার বাবাকে সপরিবারে সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়। পরে বিদেশে নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এই সময়ে বিরোধীদলের অনেক নেতাকর্মীকে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী বিনাবিচারে আটকে রাখে। ভুক্তভোগী পরিবারের একজন হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ২০১৫ সালে তার বাবা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসি কার্যকরের ৯ মাস পর হুম্মামকে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী অপহরণ করে একটি জানালাবিহীন কক্ষে আটকে রাখে।

হুম্মাম জানিয়েছেন, তাকে আয়নাঘর নামে একটি কুখ্যাত গোপন কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। আল জাজিরাকে হুম্মাম কাদের বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে এটাকে আয়নাঘর বলা হয়; কারণ এটি এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি কাউকে দেখতে পাবেন না। এটা এমনি একটি জায়গা যেখানে আপনি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন।’

আয়নাঘরে নির্যাতনের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তারা যখন খুশি আসে, তুলে নেয়, জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং মারধর করে। এটা একটা মানসিক নির্যাতন।’ শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর জোরপূর্বক গুমের শিকার কয়েকজনকে হঠাৎ ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের একজন আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ আট বছর আয়নাঘরে আটকে রাখার পর গত বছরের ৭ আগস্ট তাকে একটি রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ৬৯ হাজার ৭৯৪ ঘণ্টা আমি আটক ছিলাম। আমি রাতে কখনো ঘুমাতে পারতাম না। প্রতি রাতে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। একটু শব্দ হলেই আমি ভয় পেতাম। ওরা কি আমাকে নিয়ে যেতে আসছে? আমি শুধু ভোরের অপেক্ষা করতাম। কারণ আমি মনে করতাম, তারা আমাকে দিনের বেলায় হত্যা করবে না। আযমি আরও বলেন, ‘আটক থাকা অবস্থায় আমি প্রকৃতিক আলো দেখিনি, সূর্য, চাঁদ, আকাশ, মেঘ কিছুই দেখিনি।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো কারণ ছাড়াই ২০০৯ সালে জেনারেল আযমিকে বরখাস্ত করা হয়। এবং এর সাত বছর পর তাকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়। নিজ দেশে নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বিশ্ব থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেতে থাকেন। ভয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন মাস এসে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হযে যায়। চাকরিতে কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্র সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণার পর ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। জুলাই মাসে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনার বাসভবন ঘেরাও করে। এর মধ্যেই তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং জনগণের প্রতি তাদের সহমর্মিতার চিত্র। সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা নাগরিকদের দিকে গুলি চালাই না, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। আমরা চেয়েছি সবকিছু হোক শান্তিপূর্ণভাবে। কম রক্তপাত, কম বিশৃঙ্খলা, কম ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যেন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়।’

আরও পড়ুন

ওয়াকার-উজ-জামান আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচত নয়। তাই আমরা হস্তক্ষেপ করিনি।’

আল জাজিরা বলছে, মূলত সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে শেখ হাসিনার দুর্ভেদ্য শাসনব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। তথ্যচিত্রে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের কথা। এতে বলা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।

প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘তারা (শিক্ষার্থীরা) আমাকে ফোন দিয়েছিল, আমি বললাম, না আমি না। আমি দেশ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত হতে চাই না। বাংলাদেশে অনেক যোগ্য লোক আছে, তাদের খুঁজে বের করো। কিন্তু সবাই বলছিল, আপনাকেই সেখানে থাকতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা, বিগত সরকারের মন্ত্রী, ঘনিষ্ঠরা বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা এবং তার দোসররা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাংক ডাকাতি করেছিল, কখনো কখনো অস্তিত্ব নেই এমন কোম্পানিগুলোকেও কোটি কোটি ঋণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমার ২৮ বছরের আইএমএফের কর্মজীবনে কখনো দেখিনি যে, বেসরকারি খাতের অভিজাতদের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা দখল করা সম্ভব হয়েছে। শুধু ওই ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই নয়, নিয়ন্ত্রণ ও ডাকাতির জন্য এমনটি করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনার আমলের অনেক মন্ত্রী, এমপি এখন বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। তাদের একজন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সাবেক এই ভূমিমন্ত্রীর বার্ষিক বেতন ছিল ১৫ হাজার ডলারেরও কম। কিন্তু লন্ডনে অর্ধ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে আল জাজিরার একটি অনুসন্ধানী দল। তথ্য বলছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে তার আরও সম্পদ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আল জাজিরায় প্রকাশিত এক ভিডিওতে শোনা যায়, সম্পত্তিতে বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে থাকা আল জাজিরার সাংবাদিকদের সাইফুজ্জামান বলছেন, তার ‘খুব সুন্দর একটা পেন্টহাউস আছে’ এবং তিনি ‘স্যুট খুব পছন্দ করেন’।

ভিডিওর একপর্যায়ে স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, তিনি লন্ডনে গেলে প্রতিবারই ২-৩ হাজার পাউন্ড খরচ করে স্যুট কেনেন। আর সুপার ২০০ ও সুপার ১৮০-র মতো স্যুট তার বিশেষ পছন্দের। ‘একটা সুপার ২০০ স্যুটের খরচ পড়ে ৬ হাজার পাউন্ড (৮ হাজার ডলার)’। সাইফুজ্জামানের দাবি, শেখ হাসিনা জানতেন যে তার কাছে টাকা আছে। তিনি জানেন আমার এখানে ব্যবসা আছে। আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর এবং নিউইয়র্কে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে। যদিও সাইফুজ্জামান জোর দিয়ে বলেছেন, দেশের বাইরে তার সম্পদ সৎ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। তবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে আশাবাদের কথা জানিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এটা খুবই হতাশার, বেদনাদায়ক, লজ্জাজনক। আমার দেশ হিসেবে আমি মনে করি, এটি যাতে আর না ঘটে সেটি নিশ্চিত করা উচত।’

পতিত শেখ হাসিনার পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা উঠে এসেছে আল জাজিরার এ তথ্যচিত্রে। এছাড়াও দেশ গঠনে প্রশাসনের সংস্কারসহ, বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মেসির গোলে জয়ে ফিরল মায়ামি

রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক বিএনপি’র

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল শুনানি মঙ্গলবার

বিকেলে এলপিজি’র নতুন দাম ঘোষণা 

শাকিবের ‘তাণ্ডব’ সিনেমার সেটে স্টান্টম্যানের মৃত্যু

তুরিন আফরোজের ডক্টরেট ডিগ্রি ভুয়া : আপিল বিভাগে তথ্য দাখিল