ভিডিও শনিবার, ১০ মে ২০২৫

নদীর উজানে ভারতীয় বাঁধ

পঞ্চগড়ের ৩৯টি নদীতে পানি প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য চরম হুমুকির মুখে

পঞ্চগড়ের ৩৯টি নদীতে পানি প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য চরম হুমুকির মুখে

এম এ বাসেত, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) : নদীর উজানে ভারতীয় বাঁধের কারণে পঞ্চগড়ের ৩৯টি নদীতে পানি প্রবাহ নেই। ফলে প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্য চরম হুমুকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পঞ্চগড় সূত্রে জানা যায়, জেলায় আন্তঃসীমান্ত বড় নদী ৬টি এবং অভ্যন্তরীণ ছোট নদী ৩৩টিসহ মোট ৩৯টি নদী রয়েছে। বড় নদীগুলো হলো মহানন্দা, করতোয়া, চাওয়াই, পাথরাজ, ঘোড়ামারা ও তালমা। এসব নদীর উৎস প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন থেকে।

এসব বড় নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানি প্রবাহ অন্যত্র ঘুরিয়ে নেওয়ায় শুস্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ ছোট নদীগুলোতেও পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এখন নদীগুলোর বুকে কোথাও ধু ধু বালুচর আবার কোনখানে সবুজ ফসলের মাঠ।  নদীগুলোতে পানি প্রবাহ না থাকায় নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি এখন বিলুপ্তির পথে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া ইতিহাস ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে নদীগুলোর ভৌগোলিক গুরুত্ব বহন করে।

পঞ্চগড় সদরের সাথে তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমানা ভাগ করেছে  চাওয়াই নদী। বড় ও ছোট নদীগুলো ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে  পঞ্চগড় জেলার বুক চিরে ভাটির দেশে বয়ে গেছে। মহানন্দা নদী নেপালের হিমালয় পর্বত ও ভারতের সিকিম রাজ্যেও সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে বাংলাবান্ধা ঝাড়ুয়াপাড়া নামক স্থানে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে ভারত-বাংলাদেশ ভূখন্ডকে আলাদা করেছে।

এই মহানন্দা ঝাড়ুয়াপাড়া থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে। এছাড়া ভারত থেকে প্রবাহিত ডাহুক, করতোয়া, চাওয়াই, তালমা, পাথরাজ, ঘোড়ামারা নদী পঞ্চগড় জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তর্জাতিক সংযুক্ত নদী কমিশন চুক্তি (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও চীন) শর্তাবলী লঙ্ঘন করে বড় নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ করেছে। ফলে ভাটির দেশে নদীগুলোতে পানি প্রবাহ শুকিয়ে নদীগুলোর বুকে ধু ধু বালুচর জেগে উঠেছে।

এসব নদী মরা খাল এলাকার চাষীরা বোরো-ইরি ধানসহ নানান রবিশস্য চাষাবাদ করায় বর্তমানে নদীর বুকে ভরা জলরাশির বদলে সবুজ ফসলের মাঠ দৃশ্যপট পরিলক্ষিত হচ্ছে। নদ-নদীগুলোতে বর্ষা/শুষ্ক মৌসুমে সাধারণ পানি প্রবাহ না থাকায় নদীর চারপাশের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৩৮টি উজানে ড্যাম, ব্যারেজ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে। একইভাবে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে মহানন্দা নদীর উজানে শিলিগুড়ি (ভারত) ফুলবাড়ি নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া সদরের পুরাতন বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত খরস্রোতা মহানন্দা নদীর বুকে ধু ধু বালুচর জেগে উঠেছে।

এছাড়া ডাহুক নদীর উজানে ভারত রায়গঞ্জ নামক স্থানে স্লুইচ গেট নির্মাণ করায় নদীটি মরে গেছে। অনুরুপভাবে ভারতের রায়গঞ্জ মদনবাড়ী ও ভদ্রেশ্বর সাও নদী ও করতোয়া নদীর মিলনস্থলের উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেওয়ায় করতোয়া নদীর বুকে বালুচর জেগেছে। এই করতোয়া নদী ভজনপুর-ভদ্রেশ্বর নামক স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা ঘেঁষে পঞ্চগড় শহরের পাশ চিরে বয়ে গেছে।

একইভাবে চাওয়াই নদীর উজানে স্লুইচ গেট নির্মাণের কারণে নদীতে পানি প্রবাহ নেই। নদীর উজানে বাঁধের কারণে করতোয়া ও চাওয়াই নদীর বুকে ধুধু বালুর চর জেগে উঠেছে। এসব নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ, জোঁক, ব্যাঙ, ছোট বড় জলজ প্রাণিগুলো বিলীন হয়েছে।

আরও পড়ুন

নদীতে প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহ না থাকায় আশপাশের ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘূর্ণিঝড়, প্রচন্ড খরা, নতুন পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি গাছপালা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।

এদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত মাঝে মধ্যে সবগুলো নদ-নদীর স্লুইচ গেট একসাথে খুলে দেয়ায় নদীর ভাটির অঞ্চলে ফসলের ক্ষতিসহ বাড়িঘর বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ মানসিকভাবে হয়রানি হচ্ছে।

পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চাওয়াই নদীর পানি প্রবাহের জন্য বালু খনন করে। খননকৃত বালু ভেকু মেশিন দিয়ে নদীর দু’ধারে উঁচু বাঁধের ন্যায় ফেলে রাখে। কিন্তু বিগত বর্ষা মৌসুমে খনন করা বালু নদীতে পড়ে পুনরায় ভরে গেছে। তখন এই নদী খনন কাজের বিষয়ে পঞ্চগড় জেলার পরিবেশবাদী সুশীল সমাজ ও কয়েক জনপ্রতিনিধি রীতিমত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের পাশাপাশি পঞ্চগড় শহরে মানববন্ধন করেন।

একইভাবে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০২১-২২ অর্থ বছরে তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট নদী প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করে। এই নদীর খনন কাজের ব্যাপারেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার সুশীল সমাজ নানা প্রশ্ন তোলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বগুড়া জেলা সাধারণ সম্পাদক ও উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি মোঃ জিয়াউর রহমান বলেন, আন্তজার্তিক নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ করায় ভাটির অঞ্চলে নদীর পানি প্রবাহ নেই। অনেক বড় বড় নদী অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করায় নদীর সঠিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

ফলে অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং নদীর আশপাশে জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র হুমকির হাত থেকে রক্ষার জন্য নদীর গতিপথ সচল রাখতে সরকারকে প্রতিবেশী দেশের সাথে আলোচনা করে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শনিবার শাহবাগে গণজমায়েতের ডাক

বগুড়ার সোনাতলায় আ’লীগ নেতা বাবা-ছেলে গ্রেফতার 

জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে আওয়ামী লীগের ৪ নেতা-কর্মী গ্রেফতার

বগুড়া কাহালুর মুরইল ইউনিয়ন আ‘লীগের সা.সম্পাদক আল আমিন গ্রেফতার

প্রমত্তা করতোয়া এখন মরা খাল!

আ.লীগ নেত্রীর মেয়েকে জুলাইযোদ্ধা অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ করায় কুপিয়ে জখম