ভিডিও শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দমনে কন্টাক্ট ট্রেসিং

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দমনে কন্টাক্ট ট্রেসিং, ছবি: দৈনিক করতোয়া

বিগত সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর তান্ডব বাংলাদেশের জন-জীবনকে লন্ড-ভন্ড করে দেয়। তিন লক্ষ একুশ হাজার মানুষের হাড় ভাঙ্গা যন্ত্রণা দিয়ে সতেরশত পাঁচ জনের অতি মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নেয় এই প্রাণঘাতি ডেঙ্গু-ভাইরাস। একই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে গত ২৮শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ষাট হাজার লোকের তীব্র জ¦ালাতন সৃষ্টি করে দুইশত আশিটি মূল্যবান প্রাণ ঝরিয়েছে। তীব্রতা লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে। জুলাই থেকে আগষ্টে আক্রান্ত তিনগুণ আগষ্ট হতে সেপ্টেম্বরে তিনগুণ।

সেপ্টেম্বরে মোট আক্রান্ত ছিল ১৮, ০৯৭ এবং মৃত্যু ৮০ জন সেখানে অক্টোবরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ২৭,১৭০ জন এবং মৃত্যু ১১৭ জন। এখন বুঝতেই পারছেন অবস্থা কত বেগতিক। এই চরম ভয়াবহতার জন্য যতগুলি ফ্যাক্টর আছে তাদের মধ্য রোগীর কন্টাক্ট ট্রেসিং অন্যতম। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত কম কিন্তু মৃত্যু বেশী। আবার উত্তরসিটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশী হলেও মৃত্যু সংখ্যা কম। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটে।

সিটি করপোরেশনের বাহিরে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু কম। এখন প্রশ্ন হল রোগীর প্রকৃত ঠিকানা যদি সঠিক ভাবে পাওয়া না যায় তাহলে রোগীর সংখ্যাও মৃত্যু বাড়াতেই থাকবে। মনে করুন বরিশালে আক্রান্ত একজন রোগী যদি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি হল এবং তার ঠিকানা দেওয়া হল ঢাকা। এখন যে সংক্রমিত মশার কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির ডেঙ্গু হয়েছে, সেই মশাটি কিন্তু বরিশালে স্বাচ্ছন্দে আরও মানুষকে সংক্রমিত করেই চলছে। আবার সেই সংক্রমিত মানুষ হতে অসংক্রমিত মশা সংক্রমিত হয়ে নতুন মানুষকে আক্রান্ত করছে।

একইভাবে যদি উত্তর সিটি করপোরেশনের মশা দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি ঢাকা মেডিক্যাল বা মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ঠিকানা বিভ্রাটের কারণে আক্রান্ত মশা নিজের আনন্দে তার রক্ত শোষণের কাজ করেই চললো এবং আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তেই থাকলো। এইভাবে সিটি করপোরেশন হতে সিটি করপোরেশনের বাইরে অতিদ্রুত ছড়িয়ে ডেঙ্গ পড়ছে কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধিও সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

সেই জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মের মধ্যে পড়ে রোগীর সঠিক ঠিকানা নির্ণয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ঠিকানার চারিপাশে কমপক্ষে ২০০ বাড়ীর এরিয়া পর্যন্ত পুরোপুরি ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো। সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য ওই নির্দিষ্ট এলাকার সকল অংশীজনকে সমন্বয় করা।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগার কথা এতো এতো কার্যক্রম তবুও মশার ঘনত্ব কমে না কেন ? তবুও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু কমে না কেন। আসল কথা হল সময়, স্থান ও সুনির্র্দিষ্টভাবে যদি শত্রুকে চিহ্নিত করা না যায় তাহলে যতভাবেই ফাঁকাগুলি করা হোক না কেন লাভের লাভ কিছুই হবেনা। পূর্ণাঙ্গ মশাকে যেমন ধরা অতি কঠিন কাজ তেমনই ভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসকে খুঁজে বের করা এবং ঔষধ প্রয়োগ নির্মূল করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার । তাই মশার প্রজনন স্থল খুঁজে খুঁজে বের করে তা নির্মূল করাই শ্রেয়।

আর সংক্রমিত মশার সংখ্যা যাতে কিছুতেই বাড়তে না পারে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে অবিরাম। সেই ক্ষেত্রে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার বিকল্প নেই। একজন কীটতত্ত্ববিদই বলতে পারবে কখন কিভাবে কোন প্রজাতির মশা কোন ধরনের প্রজনন ক্ষেত্রে বেশী পরিমাণ বংশবিস্তার করে। কিভাবে একটি মশা ভাইরাস বা প্যাথোজেনিক প্রোটোজেয়া দিয়ে আক্রান্ত হয় এবং রোগ ছড়ায়।

বাংলাদেশে এই মশাবাহিত রোগ নতুন নয়। বিশ্বে ডেঙ্গু-জ¦র প্রায় ২৫০ বছরের পুরাতন রোগ হলেও আমাদের দেশে এর আবির্ভাব ১৯৬৪ সালে। তারপর ২০০০ সালে। এর পর ২০১৭ সালে আগ পর্যন্ত ঢিলেঢালা ভাবে এই রোগটির প্রাদুর্ভাব ছিল। ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর মৃত্যু আমাদের আতঙ্কিত করেছে। ডেঙ্গুর প্রভাব বেড়ে চলছে সিটি করপোরেশন হতে বিস্তৃত হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামস্তরে। সিটি করপোরেশনে যে অবকাঠামো এবং জনবল রয়েছে সেই তুলনায় প্রত্যন্ত গ্রামে সত্যিই অপ্রতুল।

আরও পড়ুন

তাই কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি করে এবং প্রতিটি সিটি করপোরেশনের জন্য একটি করে র‌্যাপিড এ্যাকশন টিম সর্বদা প্রস্তুত রাখা অতীব জরুরী। প্রতিটি টিমে অবশ্যই একজন করে কীটতত্ত্ববিদ থাকবেন। ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে ওই নির্দিষ্ট স্থানে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিশ্চিত করতে না পারলে কোনভাবেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রুখা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে আবার কসমোপলিটান নামক আরেকটা ভেরিয়েন্টের কথা শোনা যাচ্ছে।

এই শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্টের ওপর গবেষণার মাধ্যমে যেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে একইভাবে এই ভ্যারিয়েন্ট বহনকারী  মশার কি ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা অবশ্যই গবেষণার আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে যদি এর বিস্তার হয়ে থাকে তবে তা কিভাবে রোধ করা যায় তা অবশ্যই গবেষনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে জনস্বাস্থ্যে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের ইমার্জিং রি-ইমার্জিং ঘটছে। ডেঙ্গু ২৫০ বছরের পুরাতন রোগ হলেও ইয়ালো ফিভারও ৪৫০ বছরের পুরাতন রোগ।

একই বাহক এডিস মশা বাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। কিন্তু এই মশার ঘনত্ব থাকলেও ইয়ালো ফিভারের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে নেই। তবে আবার এ কথাও বলা যাবে না যে আমরা ইয়ালো ফিভারের ঝুঁকি মুক্ত। কারণ একই বাহক দ্বারা বাহিত রোগটি যে কোন সময় ছোবল মারতে পারে। তবে ইয়ালো ফিভার ছড়ানোর জন্য সিলভেটিক সাইকেল, সেমিডোমেসটিক চক্র শেষ করেই আরবান সাইকেল কমপ্লিট করে।

একই বাহক হওয়া সত্ত্বেও ক্রস প্রতিরোধ ও অন্যান্য কারণে রোগটি আমাদের দেশে এখনও প্রতীয়মান হয় নাই। এর মধ্যে হয়তবা জঙ্গলে বা সিলভেটিক সাইকেল বা চক্র সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন এডিস আফ্রিকাস, হেমাগোগাস স্পেসিস, সাবিথেস স্পেসিসের মশা প্রাথমিক চক্র সম্পন্ন করে নন হিউম্যান প্রাইমেটস বা সিম্পাজিস এর মধ্যে। একই ধারাবাহিকতায় সেমি ডোমেসটিক এডিস প্রজাতি দিয়ে মধ্যবর্তী বা সেমি আরবান চক্র সম্পন্ন করে তারপর এই মশা জঙ্গলে কাজ করতে যাওয়া মানুষ ও সিম্পাঞ্জির মধ্যে রোগটি ছড়ায়।

সর্বশেষে এডিস-এজিপ্টি মশা দ্বারা মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়ায়। এখন প্রশ্ন হলো এটাই কি ইয়ালো ফিভারের আমাদের দেশে  আবির্ভাব না হওয়ার কারণ। হ্যাঁ এটা একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে তা অবশ্যই গবেষণার দাবি রাখে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বায়নের এই যুগে আফ্রিকা সহ সকল দেশে মানুষ ও বিভিন্ন পশু পাখি ও বন্য পশুর পরিবহন ও যাতায়াতে এই ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া মোটেও অসম্ভব নয়। তাই নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট ও নতুন কোন রোগের আবির্ভাব ও প্রাদুর্ভাব রোধে রোগের ও রোগীর প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি।

এখন সময় এসেছে এমন দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য রোগীর সঠিক ইতিহাস ও রোগাক্রান্ত হওয়ার সঠিক ইতিহাস জোরালো ভাবে জানা ও সেই মত ব্যবস্থা গ্রহণ। সকল অংশীজনকে এই বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে।


লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যত দ্রুত নির্বাচন তত দ্রুত দেশ স্থিতিশীল হবে: খন্দকার মোশাররফ

ক্যালিফোর্নিয়ায় ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত

উত্তরের শীতে বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ

না ফেরার দেশে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানের গীতিকার আবু জাফর

দিনাজপুরে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৪

অস্কারে যাওয়া গান নিয়ে যা বললেন ইমন