শীতকাল: কারও উৎসব, কারো বেদনা
বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তনের এক অনন্য সৌন্দর্য আছে। এই দেশে ছয়টি ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে, আর প্রতিটি ঋতুই আমাদের জীবনে ভিন্ন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা যোগ করে। এর মধ্যে শীতকাল একটি বিশেষ ঋতু, কেউ শীত ভালোবাসেন তার শীতল সৌন্দর্যের জন্য, আবার কারও কাছে এই ঋতু ভয়ের নাম। কারণ, শীত যে সবার জন্য সমান নয়। শীত এলে দেশের শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় এক ধরনের উৎসবমুখরতা দেখা যায়। কুয়াশা ঢাকা সকাল, অতিথি পাখির কলতান, ভাপা পিঠার গন্ধ আর খেজুর রসের স্বাদ, সব মিলিয়ে শীত যেন এক আনন্দের ঋতু। সকালে কম্বল মুড়ে ঘুম, বিকেলে রোদ পোহানো, রাতে চুলার পাশে আড্ডা, এসবেই মেতে ওঠে মানুষ। কিন্তু এই আনন্দের ভেতরেও লুকিয়ে থাকে এক নির্মম বাস্তবতা, ছিন্নমূল মানুষের শীতের সংগ্রাম।
প্রতিবছর শীত এলেই শহরের ফুটপাত, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা নদীর পাড়ে দেখা যায় অসংখ্য মানুষকে উষ্ণতার খোঁজে ঘুরে বেড়াতে। যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই, তাদের কাছে শীত যেন এক অভিশাপ। অনেকেই বস্তা বা পুরোনো কাপড় মুড়ে ঠান্ডা মাটিতে রাত কাটান। কেউ বা রাস্তায় আগুন জ্বেলে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করেন। অথচ এই একই শহরে পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বা ঘরে হিটার, সোয়েটার, গরম চা সবই আছে। এই বৈষম্য যেন শীতের সঙ্গে আরও প্রকটভাবে চোখে পড়ে। শীতের রাতে ঠান্ডা শুধু কষ্টই দেয় না, নিয়ে আসে নানা রোগব্যাধি। সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি, নিউমোনিয়া এসব রোগে আক্রান্ত হয় হাজারো মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভোগে শিশুরা ও বৃদ্ধরা। চিকিৎসার অভাব, অপুষ্টি আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিবছর অসংখ্য শিশুর মৃত্যু ঘটে। অথচ সামান্য উদ্যোগ নিলেই হয়তো এই প্রাণগুলো রক্ষা করা যেত। ২০১৬ সালে প্রণীত নগর নীতিমালাতে ছিন্নমূল মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও এই নীতিমালা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে শীতের রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিবছর শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প।
এখন সময় এসেছে এই বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান শ্রেণি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তরুণ সমাজ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা জরুরি। প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী শীতবস্ত্র, খাবার বা অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। ছোট ছোট উদ্যোগ একসঙ্গে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। শীত শুধু আনন্দের নয়, এটি মানবতারও পরীক্ষা নেয়। কেউ যখন কম্বলে উষ্ণতা খোঁজে, তখন অন্য কেউ ঠান্ডায় কাঁপে। আমরা যদি সত্যিই মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে এই বৈষম্য কমাতে হবে। শীতের আনন্দ তখনই পূর্ণ হবে, যখন উষ্ণতার ছোঁয়া পৌঁছাবে প্রতিটি শীতার্ত মানুষের কাছে। শীতকাল প্রকৃতির সৌন্দর্যের ঋতু, এই ঋতু যেন কারও কাছে অভিশাপ না হয়ে ওঠে, সেটিই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
লেখক
আরও পড়ুনতানভীর আহমদ রাহী
শিক্ষার্থী
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
চট্টগ্রাম কলেজ
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








