ভিডিও বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৪:৩৩ দুপুর

দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ ও মাইক্রো ক্রেডিট 

বিশ্ব অর্থনীতির চলমান কাঠামোতে দারিদ্র্য কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, বরং একটি কৌশলগত ব্যর্থতার প্রতিফলন। যেখানে অর্থনীতির প্রবাহ যত দ্রুতগতিরই হোক না কেন, তার উপকারিতা যদি সমাজের প্রান্তিক জনগণের কাছে না পৌঁছায়, তবে সেই প্রবৃদ্ধি হয় অন্তঃসারশূন্য, অসাম্যপূর্ণ এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক। বাংলাদেশ, একটি কৃষিনির্ভর উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, তার জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ যুগের পর যুগ ধরে প্রান্তিক পর্যায়ে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার সাথে লড়াই করে জীবন ধারণ করছে। তবে বাংলাদেশ আজ এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন, আর গ্রামীণ অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে দারিদ্র্য বিমোচনের নিরব বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়েছে, যার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্রঋণ। এরই প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ এবং ‘মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি আইন’। একদিকে এটি অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে নীতিগত শৃঙ্খলার মাধ্যমে সেই সুযোগকে নিরাপদ ও টেকসই করবে। এই দুটি উদ্যোগ শুধু একটি দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল নয়, বরং একটি বিকল্প উন্নয়ন দর্শন, যার মাধ্যমে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষও হয়ে উঠতে পারে অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এক সময়ের অবিশ্বাস্য এই ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা আজ বাস্তব ,যেখানে গরিব মানুষ জামানত ছাড়াই ঋণ পাবে। এই ঋণের সাহায্যে কেউ গড়ে তুলেবে হাঁস-মুরগির খামার, কেউ করবে মৌসুমি ফসলের চাষ, কেউ বা সেলাই মেশিন চালিয়ে নিজের সংসারের আলো জ্বালাবে। এই ঋণ শুধু পুঁজি নয়, এটি সম্মান, আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যতের প্রতি এক দৃঢ় আস্থা। এতদিন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে মূলত বেসরকারি সংস্থা ও এনজিওদের মাধ্যমে। কিন্তু এখন সরকার ক্ষুদ্রঋণকে আনতে চাইছে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থায়ী কাঠামোর ভেতরে। এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই হলো ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো শুধু ঋণ দেবে না, সঞ্চয় রাখবে, দুর্যোগে বিমা দেবে, আর প্রযুক্তিনির্ভর সেবার মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে। মোবাইল ফোনে অ্যাপ ব্যবহার করেই প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার হিসাব জানতে পারবে, নিজের সঞ্চয়ের খোঁজ রাখতে পারবে। পাশাপাশি ২০০৬ সালের মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি আইনটি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের শৃঙ্খলা আনবে, গ্রাহককে সুরক্ষা দেবে, সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। এই আইন এখন আরও আধুনিকায়নের পথে। এ যেন একটি পরিপূর্ণ গার্ডরেল, যা দারিদ্র্য বিমোচনের যাত্রাপথকে সুরক্ষিত করবে। মূলত প্রান্তিক মানুষগুলো যখন আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এবং নতুন ধারার প্রয়োগ নিজের ব্যবসা চালাবেন, তাদের নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবেন এবং দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবেন তখনই হবে সত্যিকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। বর্তমান সময়ের বৈদেশিক অর্থনৈতিক অবস্থায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক এবং মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি আইন অর্থনীতিতে একটি সমন্বিত কাঠামো প্রতিষ্ঠা করবে, যা দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব হ্রাস, গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্জাগরণ, এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে একটি সুসংগত প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসবে। এই কাঠামোর কেন্দ্রে থাকবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সেবার প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরির জন্য অর্থ সহায়তা ও পথপ্রদর্শন এবং গ্রামীণ সমাজের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। যা পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে এবং বেকারত্ব হ্রাস করবে। পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক কাঠামো বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দারিদ্র্য নির্মূল এবং শোভন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যগুলো এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, যা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে, এই কাঠামো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক এবং নিয়ন্ত্রক আইনের সমন্বয় গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষমতায়নের জন্য একটি কার্যকর কৌশল প্রদান করতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি নজির স্থাপন করবে। এই মডেল অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য একটি সার্বজনীন কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই অর্থনৈতিক কাঠামোর সম্ভাবনা সত্ত্বেও কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। অতিরিক্ত ঋণের ঝুঁকি এবং আর্থিক সাক্ষরতার অভাব ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবকে সীমিত করতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় নীতিগত সংস্কার অপরিহার্য। আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচির প্রসার, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ঋণের সঠিক ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সচেতন করা এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় দক্ষ করে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নমনীয় ঋণ শর্তাবলী এবং প্রণোদনামূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যা অর্থনৈতিক কাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত করা সহজ হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গ্রামীণ জনপদ, কৃষি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এই তিনটি স্তম্ভকে যদি একই নীতিগত কাঠামোর আওতায় এনে কার্যকরভাবে পুষ্ট করা যায়, তবে যে কোনো অর্থনৈতিক রূপান্তর বাস্তবায়ন সম্ভব। বিশ্বব্যাপী যখন দারিদ্র্য হ্রাস ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে একটি আদর্শ মডেল। কারণ এখানে ক্ষুদ্রঋণ কেবল টাকাপয়সার লেনদেন নয়, এটি একটি নৈতিক দায়, একটি উন্নয়নের দর্শন, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর সামাজিক ন্যায়ের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। তবে কেবল আইনের খোলস তৈরি করলেই হবে না, প্রয়োজন কার্যকর বাস্তবায়ন, পর্যাপ্ত তদারকি, প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থা, এবং সর্বোপরি একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যাতে কেউ ঋণের ফাঁদে না পড়ে, বরং প্রতিটি গ্রাহক তার সক্ষমতা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পায়। দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে প্রান্তিক জনগণের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। তবেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের উন্নয়ন শুধু সংখ্যায় নয়, ব্যাপ্ত হবে সম্ভাবনায় এবং বাস্তবতায়। যা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

 

লেখক 

আরও পড়ুন

প্রজ্ঞা দাস

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ 
ইডেন মহিলা কলেজ 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ধুনটে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার  

হবিগঞ্জে খড়বোঝাই ট্রাক থেকে গাঁজা উদ্ধার, আটক ২

বগুড়া-৩ আসনে জাতীয় পার্টির  প্রার্থীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ 

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিলেন হাজী ইয়াছিন

তাইওয়ানে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প

যশোর-৩ আসনে অমিতের মনোনয়ন সংগ্রহ