শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আজকের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একেবারে শেষ পর্যায়ে ঘাতক ও কুচক্রী মহলের নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার মানসে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশস্বরূপ সুপরিকল্পিতভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এইসব বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গকে নৃশংস ভাবে হত্যার কারণে ইতিহাসের জঘন্যতম কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল। যার ঘৃণা ও নিন্দা জানানোর ভাষা আজও জানা নেই সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে। এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও আমাদের দেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকেই দোষারোপ করে আসছে এবং এই সত্যটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অনেকের কাছেই প্রশ্ন উঠেছে ঠিক যে সময়ে বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয় তার বেশ কয়েকদিন আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস শুরুর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা স্বাধীন হওয়ার খবর যেমন পাওয়া যায় এবং ওই সব এলাকায় অবস্থান করা পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে বন্দি অবস্থায় থাকার খবরও তেমনি পাওয়া যায়। সেই সময়ে দেশের যে সকল এলাকা স্বাধীন হয়েছে সেইসব এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের এবং সংগৃহীত যাবতীয় অস্ত্রসস্ত্রসহ রাজধানী শহর ঢাকা জেলাকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে যাত্রা শুরু ঢাকা অভিমুখে। সারা দেশে ততক্ষণে বিজয়ের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, ইতোমধ্যে স্বাধীন এলাকায় বিজয় মিছিল বের হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় এবং হানাদার বাহিনীর পরাজয় এবং চরম আতংকের দিনাতিপাত ঠিক সেই মুহূর্তে বিজয়ের মাত্র দুই এক দিন আগে এতো শক্তি কোথায় পেলো শত্রুরা যে তারা খুবই ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলো। বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে প্রশ্নগুলো এসে যায় কে বা কাহারা হত্যা করলো এই বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গকে। পর্দার আড়ালে কাদের ইন্ধন ছিল এই হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য। এনারা সকলেই ছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে আপন মহিমায় উদ্ভাসিত জাতির সূর্য সন্তান। তাদের দেশপ্রেম, মেধা ও জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞানের আলোক বর্তিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন সমগ্র জাতির মাঝে। এই জাতিকে ওনাদের আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিলো কিন্তু বড়োই দূর্ভাগ্য জাতি সেটা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলো। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ধুদ্ধ ছিলেন এই জ্ঞানতাপস ব্যক্তিগণ, ওনারা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতেন দেশ স্বাধীন হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করার দায়িত্ব আবারো কাঁধে তুলে নিবেন, পরিবর্তন করবেন ঘুঁনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে, মনোনিবেশ করবেন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে সব আশা দুরাশায় পরিণত হলো।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ স্বাধীনতার পক্ষের মানসিকতা সম্পন্ন হলেও অবশ্যই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দর্শনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সেই বিশ্বাস ছিলো তাদের মনের মনোমন্দিরে। বাহিরের মানুষ দূরের কথা পরিবারের মানুষগুলোও হয়তোবা জানতো না ওনারা কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ছিলো তাদের কাছে সমান। আজ চুয়ান্নটা বছর পাড়ি দেওয়ার পর আমরা দেখছি জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের হাতছানি। এখনকার বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের দিকে তাকাই যখন তখন দেখতে পাই প্রায় সবাই প্রকাশ্যে রাজনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তাদের বিবেক জ্ঞান বুদ্ধি মনুষ্যত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে কখনো কখনো রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও নোংরা ভাষায় কথা বলছে, লেজুড়বৃত্তিক মানসিকতা পোষণ করে সর্বত্র। অর্থ, ক্ষমতা ও বিলাসিতার মোহ তাদেরকে এমন এক পর্যায়ে নেমে নিয়ে এসেছে বলে বিবেকসম্পন্ন যে কোনো মানুষ করুণা ও ঘৃণার চোখে দেখে তাদেরকে, জ্ঞানপাপী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অথচ এনাদেরই পূর্বসূরিরা ছিলেন জাতির বিবেক এবং অত্যন্ত সম্মানের আসনে অধিষ্ঠ তাদের নাম যা আজ-ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে বাঙালি জাতির হৃদয়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা--
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ১. এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ২. ডঃ জি সি দেব, ৩. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ৪. আনোয়ার পাশা, ৫. ডঃ জ্যোতির্ময়, গুহঠাকুরতা, ৬. আবদুল মুকতাদির, ৭. এস এম রাশীদুল হাসান, ৮. ডঃ এন এম ফয়জুল মাহী, ৯. ফজলুর রহমান খান, ১০. এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ১১. ডঃ সিরাজুল হক খান, ১২. ডঃ শাহাদাত আলী, ১৩. ডঃ এম এ খায়ের, ১৪. এ আর খান খাদিম, ১৫. মোঃ সাদিক , ১৬. শরাফত আলী, ১৭. গিয়াসউদ্দীন আহমদ, ১৮. আনন্দ পয়ান ভট্টাচার্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : ১. অধ্যাপক কাইয়ুম, ২. হাবীবুর রহমান, ৩. শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ৪. ডঃ আবুল কালাম আজাদ। সাবেক গণপরিষদ সদস্য- ১. মসিউর রহমান, ২. আমজাদ হোসেন, ৩. আমিনুদ্দীন, ৪. নজমুল হক সরকার, ৫. আবদুল হক, ৬. ডাঃ জিকরুল হক, ৭. সৈয়দ আনোয়ার আলী, ৮. এ কে সরদার।
সাংবাদিক - ১. সিরাজুদ্দীন হোসেন, ২. শহীদুল্লাহ কায়সার, ৩. খোন্দকার আবু তালেব, ৪. নিজামুদ্দীন আহমদ, ৫. আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ৬. শহীদ সাবের, ৭. শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), ৮. নজমুল হক, ৯. এম আখতার, ১০. আবুল বাসার, ১১. চিশতী হেলালুর রহমান, ১২. শিবসদন চক্রবর্তী, ১৩. সেলিনা আখতার
আরও পড়ুনচিকিৎসাবিদ : ১. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ২. আবদুল আলীম চৌধুরী, ৩. সামসুদ্দীন আহমদ, ৪. আজহারুল হক, ৫. হুমায়ুন কবীর, ৬. সোলায়মান খান, ৭. কায়সার উদ্দীন, ৮. মনসুর আলী, ৯. গোলাম মর্তুজা, ১০. হাফেজ উদ্দীন খান, ১১. জাহাঙ্গীর, ১২. আবদুল জব্বার, ১৩. এস কে লাল, ১৪. হেমচন্দ্র বসাক, ১৫. কাজী ওবায়দুল হক, ১৬. মিসেস আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী, ১৭. আলহাজ্জ্ব মমতাজ উদ্দীন, ১৮. হাসিময় হাজরা, ১৯. নরেন ঘোষ, ২০. জিকরুল হক, ২১. সামসুল হক, ২২. এস রহমান, ২৩. এ গফুর, ২৪. মনসুর আলী, ২৫. এস কে সেন, ২৬. মফিজ উদ্দীন, ২৭. অমূল্য কুমার চক্রবর্তী, ২৮. আতিকুর রহমান, ২৯. গোলাম সরওয়ার, ৩০. আর সি দাশ, ৩১. মিহির কুমার সেন, ৩২. সালেহ আহমদ, ৩৩. অনীল কুমার সিংহ, ৩৪. সুশীল চন্দ্র শর্মা, ৩৫. এ কে এম গোলাম মোস্তফা, ৩৬. মকবুল আহমদ, ৩৭. এনামুল হক, ৩৮. মনসুর (কানু), ৩৯. আশরাফ আলী তালুকদার, ৪০. লেঃ জিয়ায়ুর রহমান, ৪১. লেঃ কঃ জাহাঙ্গীর, ৪২. বদিউল আলম, ৪৩. লেঃ কঃ হাই, ৪৪. মেজর রেজাউর রহমান, ৪৫. মেজর নাজমুল ইসলাম, ৪৬. আসাদুল হক, ৪৭. নাজির উদ্দীন, ৪৮. লেঃ নূরুল ইসলাম, ৪৯. কাজল ভদ্র , ৫০. মনসুর উদ্দীন। আরও ১. জহির রায়হান ( চলচ্চিত্র পরিচালক), ২. পূর্ণেন্দু দস্তিদার (সাহিত্যিক), ৩. ফেরদৌস দৌলা (সাহিত্যিক), ৪. ইন্দু সাহা (সাহিত্যিক), ৫. মেহরুন্নেসা (সাহিত্যিক), ৬. আলতাফ মাহমুদ (শিল্পী), ৭. দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা, ৮. ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (রাজনৈতিক নেতা), ৯. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী), ১০. শামসুজ্জামান (চিফ ইঞ্জিনিয়ার), ১১. মাহবুব আহমদ (সরকারি কর্মচারী), ১২. খুরশীদ আলম (ইঞ্জিনিয়ার), ১৩. নজরুল ইসলাম (ইঞ্জিনিয়ার), ১৪. মোজাম্মেল হক চৌধুরী (ইঞ্জিনিয়ার), ১৫. মহসিন আলী (ইঞ্জিনিয়ার), ১৬. মুজিবুল হক ( সরকারি কর্মচারী)।
উপরোক্ত শহীদদের মাঝে জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হওয়ার দেড়মাস পরে অর্থাৎ ৩০শে জানুয়ারি ১৯৭২ সালে শহীদ হন। তখন দেশ স্বাধীন, তাহলে কিভাবে উনি পরাজিত শক্তির দ্বারা শহীদ হন। ১৪ই ডিসেম্বরের শহীদদের সাথে একই কাতারে মিলেমিশে একাকার করার ঘৃণ্য চেষ্টা তৎকালীন সময় থেকেই অব্যাহত রয়েছে। তবে কি জহির রায়হান শহীদ হওয়ার নেপথ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির অদৃশ্য হাত ছিলো। অনেক কিছুই শোনা যায় যেমন ভারতে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা নিয়ে প্রমাণ সহ অসংখ্য তথ্যচিত্র ছিল ওনার কাছে। আর এই কারণেই হত্যার শিকার হতে হয় ওনাকে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সকল শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা, মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে সকলের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং সকল শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমগ্র দেশবাসীকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের বিকল্প ছাড়া আর কিছুই নেই।
লেখক
শাব্বীর পল্লব
প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন

নিউজ ডেস্ক








