ভিডিও রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০২:১৯ রাত

ধীরগতি কাটিয়ে ইন্টারনেট সুপারফাস্ট করার উপায়

ধীরগতি কাটিয়ে ইন্টারনেট সুপারফাস্ট করার উপায়

মোঃ রেজাউল করিম রাজু : বর্তমান সময়ে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ছাড়া যেমন এক মুহূর্ত চলা দায়, তেমনি ইন্টারনেট ছাড়া জীবন অনেকটাই অচল। ফাইভজি প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব, বাংলাদেশও সেই দৌড়ে শামিল হয়েছে। আজকাল অনেকেই ফাইভজি সাপোর্টেড দামী হ্যান্ডসেট কিনছেন, উচ্চমূল্যে বড় ডেটা প্যাকেজ বা ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এত সব আয়োজনের পরও দিনশেষে ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশের অভিযোগ ইন্টারনেট ধীরগতি।

জরুরি মেইল পাঠানো, ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ, অনলাইন ক্লাস কিংবা নিছক বিনোদন সবকিছুতেই যখন 'বাফারিং' বা 'লোডিং' আইকন ঘুরতে থাকে, তখন বিরক্তি চরমে পৌঁছায়। অথচ ব্যবহারকারীরা জানেন না যে, সবসময় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা মোবাইল অপারেটরের দোষ থাকে না। অনেক সময় আমাদের ব্যবহৃত ডিভাইস, রাউটার বা কিছু সেটিংসের কারণেও ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। আজকের ফিচারে আমরা আলোচনা করব, কীভাবে কিছু সাধারণ কৌশল ও প্রযুক্তিগত টিপস মেনে চললে ইন্টারনেটের গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব।

ডিজিটাল বাস্তবতায় ইন্টারনেটের ধীরগতি কেন সমস্যা?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক চাহিদার মতোই জরুরি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের পথে ফ্রিল্যান্সার থেকে শুরু করে করপোরেট পেশাজীবী সবাই উচ্চগতির ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। একটি সাধারণ ভিডিও কলে যদি কথা আটকে যায় কিংবা জরুরি ফাইল আপলোড করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে, তবে তা কেবল সময়ের অপচয় নয়, বরং আর্থিক ক্ষতিরও কারণ।

অনেক সময় দেখা যায়, আইএসপি আপনাকে ঠিকঠাক ব্যান্ডউইথ দিচ্ছে, কিন্তু আপনার রাউটার বা ডিভাইসের সীমাবদ্ধতার কারণে আপনি সেই গতি পাচ্ছেন না। এই সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকাটা এখন সময়ের দাবি।

ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর কার্যকরী কৌশলসমূহ : ইন্টারনেটের গতি বাড়ানো কোনো জাদুর বিষয় নয়, এটি মূলত হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। নিচে ইন্টারনেট গতি বাড়ানোর কিছু পরীক্ষিত পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:

১. রাউটারের অবস্থান বা 'প্লেসমেন্ট' : অধিকাংশ বাড়িতে বা অফিসে রাউটার স্থাপন করা হয় ঘরের এক কোণে কিংবা জানালার পাশে, যেখানে তারের সংযোগ সহজ। এটি একটি ভুল ধারণা। ওয়াই-ফাই সিগন্যাল অনেকটা বাতির আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাউটার যদি ঘরের এক কোণে থাকে, তবে সিগন্যালের অর্ধেকটা দেয়ালের বাইরে বা প্রতিবেশীর বাড়িতে চলে যাচ্ছে।

  • পরামর্শ: রাউটারটিকে বাড়ির বা অফিসের ঠিক মাঝখানে এবং কিছুটা উঁচুতে (যেমন আলমারির ওপরে বা সিলিংয়ের কাছাকাছি) স্থাপন করুন। এতে সিগন্যাল সব দিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে। মাইক্রোওয়েভ ওভেন বা কর্ডলেস ফোনের পাশে রাউটার রাখবেন না, কারণ এগুলো সিগন্যালে ব্যাঘাত ঘটায়।

২. ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের সঠিক ব্যবহার : আধুনিক ডুয়াল ব্যান্ড রাউটারগুলোতে দুটি ফ্রিকোয়েন্সি থাকে ২.৪ গিগাহার্টজ এবং ৫ গিগাহার্টজ।

  • ২.৪ গিগাহার্টজ: এর রেঞ্জ বা কাভারেজ বেশি, অর্থাৎ দেয়াল ভেদ করে দূরে সিগন্যাল পাঠাতে পারে, কিন্তু গতি কিছুটা কম।
  • ৫ গিগাহার্টজ: এর রেঞ্জ কম, কিন্তু গতি অনেক বেশি।
  • করণীয়: আপনি যদি রাউটারের কাছাকাছি থেকে ভারী কাজ (যেমন গেমিং বা ৪কে ভিডিও স্ট্রিমিং) করেন, তবে ৫ গিগাহার্টজ ব্যান্ড ব্যবহার করুন। আর যদি অন্য ঘর থেকে ব্রাউজ করেন, তবে ২.৪ গিগাহার্টজ বেছে নিন।

৩. ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপ এবং অটো-আপডেট বন্ধ করা : স্মার্টফোন বা পিসিতে আমরা যখন কাজ করি, তখন অজান্তেই ব্যাকগ্রাউন্ডে অনেক অ্যাপ চলতে থাকে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ক্লাউড স্টোরেজগুলো সারাক্ষণ ডেটা সিঙ্ক করতে থাকে। এছাড়া উইন্ডোজ আপডেট বা অ্যাপ স্টোর আপডেট চালু থাকলে তা আপনার ব্যান্ডউইথের বড় একটি অংশ দখল করে নেয়।

  • পরামর্শ: পিসির টাস্ক ম্যানেজার বা ফোনের সেটিংস থেকে দেখুন কোন অ্যাপগুলো বেশি ডেটা খাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যাকগ্রাউন্ড প্রসেস বন্ধ করুন এবং 'অটো-আপডেট' শিডিউলটি এমন সময়ে দিন যখন আপনি কাজ করছেন না (যেমন গভীর রাতে)।

৪. ব্রাউজার ক্যাশ ও কুকিজ পরিষ্কার করা : অনেকেই অভিযোগ করেন ব্রডব্যান্ড স্পিড ঠিক আছে, কিন্তু ক্রোম বা ফায়ারফক্স ব্রাউজারে ওয়েবসাইট লোড হতে দেরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ব্রাউজিং করার ফলে ব্রাউজারে প্রচুর 'ক্যাশ' এবং 'কুকিজ' জমা হয়, যা ব্রাউজারকে ভারী করে তোলে।

  • করণীয়: নিয়মিত ব্রাউজারের হিস্ট্রি এবং ক্যাশ ফাইল পরিষ্কার করুন। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় এক্সটেনশন বা অ্যাড-অনস রিমুভ করলে ব্রাউজিং স্পিড বাড়বে।

৫. ডিএনএস সার্ভার পরিবর্তন : সাধারণত আমরা ডিফল্টভাবে আইএসপি-র দেওয়া ডিএনএস সার্ভার ব্যবহার করি। অনেক সময় আইএসপি-র সার্ভার ধীরগতির হলে ওয়েবসাইট লোড হতে দেরি হয়।

  • পরামর্শ: আপনি গুগল ডিএনএস বা ক্লাউডফ্লেয়ার ডিএনএস ব্যবহার করতে পারেন।
    • গুগল ডিএনএস: 8.8.8.8 এবং 8.8.4.4
    • ক্লাউডফ্লেয়ার ডিএনএস: 1.1.1.1 (এটি সাধারণত দ্রুততম এবং নিরাপদ)।
      রাউটার বা ডিভাইসের নেটওয়ার্ক সেটিংসে গিয়ে এই ডিএনএস বসিয়ে নিলে ব্রাউজিংয়ে দ্রুততা অনুভব করবেন।
  •  

৬. পুরনো হার্ডওয়্যার পরিবর্তন : আপনার ইন্টারনেট প্যাকেজ হয়তো ১০০ এমবিপিএস, কিন্তু আপনার রাউটারটি যদি ৫ বছরের পুরোনো হয় এবং কেবল ৩০০ এমবিপিএস সাপোর্টেড হয়, তবে আপনি পূর্ণ গতি পাবেন না। একইভাবে, ইথারনেট ক্যাবল যদি পুরোনো ক্যাটাগরির (যেমন ক্যাট-৫) হয়, তবে তা উচ্চগতি পরিবহনে অক্ষম।

  • করণীয়: উচ্চগতির প্যাকেজ ব্যবহার করলে গিগাবিট রাউটার এবং অন্তত ক্যাট-৬ ইথারনেট ক্যাবল ব্যবহার করুন।

বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: গতির সমীকরণ

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের চিত্র গত এক দশকে আমূল বদলে গেছে। বিটিআরসি এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে ফাইবার অপটিক সংযোগের কারণে ব্রডব্যান্ড গতি এখন বিশ্বমানের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। অনেক আইএসপি এখন বাসা-বাড়িতেই ২০-৫০ এমবিপিএস গতির সংযোগ দিচ্ছে, যা ৫ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।

তবে মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে চিত্রটি মিশ্র। যদিও অপারেটররা ফোরজি  এবং কিছু এলাকায় ফাইভজি চালুর ঘোষণা দিয়েছে, তবুও ওকলা স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এর মূল কারণ স্পেকট্রাম বা তরঙ্গের অপ্রতুলতা এবং ব্যবহারকারীর ঘনত্বের তুলনায় টাওয়ারের সক্ষমতা কম থাকা।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো যেখানে গড়ে ১০০ এমবিপিএস-এর ওপরে মোবাইল ইন্টারনেট গতি দিচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এবং ডিভাইসের সঠিক কনফিগারেশন গতি প্রাপ্তিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ভিপিএন এবং অ্যাড-ব্লকারের ভূমিকা

অনেকেই নিরাপত্তার জন্য ভিপিএন ব্যবহার করেন। মনে রাখবেন, সাধারণ মানের বা ফ্রি ভিপিএন ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়, কারণ আপনার ডেটা অন্য একটি দেশের সার্ভার ঘুরে আসে। গতি বাড়াতে চাইলে কাজ শেষে ভিপিএন বন্ধ রাখুন। অন্যদিকে, ভালো মানের 'অ্যাড-ব্লকার' ব্যবহার করলে ওয়েবসাইটে থাকা অপ্রয়োজনীয় ভারী বিজ্ঞাপন লোড হওয়া বন্ধ হয়, ফলে পেজ দ্রুত লোড হয় এবং ডেটাও সাশ্রয় হয়।

আরও পড়ুন

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও গতিই যেখানে শেষ কথা

আগামী দিনগুলোতে ইন্টারনেটের গতি কেবল ব্রাউজিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। 'ইন্টারনেট অফ থিংস' এর প্রসারের ফলে ঘরের ফ্রিজ, টিভি থেকে শুরু করে বাতি সবকিছুই ইন্টারনেটে যুক্ত হবে। তখন রাউটারের ওপর চাপ বাড়বে বহুগুণ।

প্রযুক্তি বিশ্বে এখন 'ওয়াই-ফাই ৬' এবং 'ওয়াই-ফাই ৭' নিয়ে আলোচনা চলছে। এই নতুন প্রযুক্তির রাউটারগুলো একই সঙ্গে অনেকগুলো ডিভাইসকে উচ্চগতিতে ডেটা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশেও অদূর ভবিষ্যতে আইএসপিগুলো এই প্রযুক্তি গ্রহণ করবে। এছাড়া স্যাটেলাইট ইন্টারনেট (যেমন স্টারলিঙ্ক) প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার বিপ্লব ঘটাতে পারে।

ইন্টারনেট এখন আমাদের জীবনের লাইফলাইন। ধীরগতির ইন্টারনেট যেমন বিরক্তির কারণ, তেমনি কাজের গতিও কমিয়ে দেয়। তবে সব দোষ আইএসপি-র ওপর না চাপিয়ে, একজন সচেতন ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। রাউটারের সঠিক অবস্থান, নিয়মিত রিস্টার্ট দেওয়া, ব্যাকগ্রাউন্ড ডেটা নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক হার্ডওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিদ্যমান সংযোগ থেকেই সর্বোচ্চ গতি বের করে আনতে পারি।

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জানলে, সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও ডিজিটাল দুনিয়ায় দ্রুততম থাকার অভিজ্ঞতা পাওয়া সম্ভব। তাই অভিযোগ করার আগে একবার নিজের সেটিংসগুলো যাচাই করে দেখুন—হয়তো একটি ছোট্ট পরিবর্তনেই আপনার ইন্টারনেট দৌড়াবে রকেটের গতিতে। যে কোনো মতামত, তথ্য বা প্রতিক্রিয়ার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন :  rajuitnews@gmail.com

 

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ধীরগতি কাটিয়ে ইন্টারনেট সুপারফাস্ট করার উপায়

৩৬ বাংলাদেশিকে নাগরিকত্ব দিলো ভারত

ইরানে ৬০ লাখ লিটার চোরাই ডিজেলসহ ট্যাঙ্কার জব্দ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

বিকাশকর্মীকে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের হতাহতের ঘটনায় তারেক রহমানের শোক