বলিউড অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে এমন এক অভিনয়শিল্পী, যাঁকে ঘিরে রহস্যটা যেন তাঁর স্বভাবগত অলংকার। তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেন মনে হয় চরিত্রই তাঁকে নিজের গভীর গহ্বরে টেনে নিয়েছে। যেন তিনি অভিনয় করছেন না, বাস করছেন। যেন তিনি আর রাধিকা নন। এক অচেনা, নীরব, তীক্ষ্ণ নারীর শরীর ও মন ধার করে বেঁচে আছেন। এই বিশেষ ক্ষমতাই তাঁকে সময়ের সবচেয়ে সাহসী, পরীক্ষামূলক, আর শিল্পিত অভিনেত্রীদের তালিকায় আলাদাভাবে স্থান দিয়েছে। রাধিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল মঞ্চনাটক দিয়ে। সেই ছোট ছোট মঞ্চেই ধরা পড়ে তাঁর অভিব্যক্তির বিস্ফোরণ। পরে তিনি মারাঠি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, ভারতের প্রায় সব ভাষার সিনেমায় কাজ করেছেন সমান স্বাচ্ছন্দ্যে, সমান তীক্ষ্ণতায়। তাঁর ফিল্মোগ্রাফি যেন এক বৈচিত্র্যময়। ‘শোর ইন দ্য সিটি’, ‘বদলাপুর’, ‘পার্চড’, ‘ফোবিয়া’, ‘আন্ধাধুন’, ‘মনোলগ’, ‘লাস্ট স্টোরিজ’, ‘সেক্রেড গেমস’ প্রতিটি কাজে তিনি যেন নিজেরই অন্যরকম কোনো রূপ খুঁজে পেয়েছেন। আর সেই ধারাবাহিকতা এবার পৌঁছেছে নতুন এক গন্তব্যে ‘সালি মহব্বত’ এ। এই ওয়েব সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী টিসকা চোপড়া।
এটি তাঁর পরিচালনায় নির্মিত প্রথম সিনেমা। ডিরেক্টরিয়াল ডেবিউতেই তিনি দেখিয়েছেন, মনের গভীর ছায়াগুলো কীভাবে আলো-অন্ধকারে তুলে ধরতে হয়। তাঁর নির্দেশনায় আছে ধৈর্য, সংবেদনশীলতা, আর একজন নারীর অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম, নীরব যাত্রা।
টিসকা তাঁর সিনেমার গল্প বলেছেন ভিজ্যুয়াল দিয়ে। ফ্রেমের ভিতরে ফুরসতগড় নামে নিস্তব্ধ শহরটিকে তিনি সাজিয়েছেন যেন একটি জীবন্ত চরিত্রের মতো। ফুরসতগড় শহরটা যেন সময়ের বাইরে এক নিষ্প্রাণ দ্বীপ। নিঃশব্দ, ধুলোমাখা, একটু বিষণ্ন। কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরেই আছে অস্থিরতা। এই শহরেই বাস করেন স্মিতা। এই চরিত্র অভিনয় করেছেন রাধিকা আপ্তে। অতি সাধারণ এক গৃহবধূ। সকালে বাগান করা, দুপুরে রান্না, বিকেলে চা, সন্ধ্যায় সংসার। চোখ বন্ধ করলেই যেন আমরা তাঁকে দেখতে পাই শান্ত, নিখুঁত, বিনয়ী, অপ্রাণবন্ত একজন হিসেবে। কিন্তু টিসকার পৃথিবীতে ‘সাধারণ’ শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে থাকে গভীর অস্বস্তি। একদিন শহরে ঘটে এক ভয়াবহ দ্বৈত হত্যাকাণ্ড। ছোট শহরের দেয়াল ফিসফিস করতে থাকে- ভয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তায়। পুলিশ তদন্ত যত এগোয়, ততই উঠে আসে স্মিতার অতীতের গোপন স্তরগুলো। দর্শক ভাবতে শুরু করেন, স্মিতা কি সত্যিই সাধারণ? নাকি তাঁর নিঃশব্দ দৃষ্টির ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক অন্ধকার, যা এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু?
কিছুদিন আগে প্রকাশ হওয়া সিনেমার ট্রেলারে রাধিকাকে দেখা গেছে অল্প কথায়, বেশি নীরবতায়, শুধু চোখের ভাষায় নিজের ভেতরের যুদ্ধ প্রকাশ করতে। তাঁর একেকটা দৃষ্টি, একেকটা ভুলে যাওয়া নিঃশ্বাস যেন গল্পের নতুন ক্লু। রাধিকা বলেন, ‘স্মিতার নিঃশব্দ জগতে যে অস্বস্তি, তা আমাকে আমার গভীরতম ভয়গুলো নতুন করে অনুভব করতে বাধ্য করেছে।’
এই সিনেমায় তদন্ত কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্যেন্দু শর্মা। যিনি ‘মির্জাপুর’-এর মুননার পর এখানে একেবারেই ভিন্নরূপী, সংযত, বুদ্ধিদীপ্ত পুলিশ অফিসার। শুধুই অ্যাকশন নয় অদ্ভুত নরম। স্মিতার দিকে তাকানোর ভঙ্গিতে বোঝা যায়, তিনি শুধু অপরাধ খুঁজছেন না, মানুষটিকেও বুঝতে চাইছেন। দিব্যেন্দুর কথায় ‘রাধিকাকে সঙ্গে পাওয়া মানেই অভিনয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতা। তাঁর নীরবতা কখনো কখনো সংলাপের চেয়ে বেশি শব্দ করে।’
সামাজিক মাধ্যমে নির্মাতা ও অভিনেতা অনুরাগ কশ্যপের রহস্যময় চরিত্রটি ঘিরেও চলছে আলোচনার ঝড়।
তাঁর উপস্থিতিতে গল্পে যোগ হয়েছে এক ধরনের দৃশ্যমান নয়, অথচ ছায়ার মতো উপস্থিত অন্ধকার। দর্শক উপলব্ধি করতে পারেন। কিছু একটা গোপন আছে, কিন্তু কি? কীভাবে? অন্যদিকে সোরাসেনি মৈত্র, কুশা কপিলা, শরৎ সাক্সেনা প্রতেকেই গল্পকে আরও বাস্তব, আরও বহুমাত্রিক করেছেন। টেলার দেখে বোঝাই যায় টিসকা চোপড়ার পরিচালনা অনেকটাই পরিণত। এই গল্প তিনি শুধু বানাননি। আলো-ছায়ার ব্যবহার, দূরের ট্রেনের শব্দ, পাখির ডাক, শুকনো বাতাসের শীতল স্পর্শ সব মিলিয়ে ফুরসতগড় যেন শহর নয়, এক আবেশ নিয়ে এসেছেন। যে আবেশে ভয় আছে, আকর্ষণ আছে, আছে এক অদ্ভুত অন্ধকার।
সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে টিসকা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি হঠাৎ নির্মাণে আসেননি। ধীরে ধীরে, স্তর স্তর করে তিনি চরিত্রগুলোকে খোলেন যেন পাঠক বই পড়ছেন, আর প্রতিটি পাতার নিচে লুকিয়ে আছে আরেকটি পাতা।
সব মিলিয়ে বলা যায় থ্রিলার নয় এক নারীর গভীর আত্মযাত্রা ‘সালি মহব্বত’। এটি স্মিতার নিজের ভেতরের অন্ধকার দেখার গল্প। নিজের অতীতের মুখোমুখি দাঁড়ানোর গল্প। এক নারীর নিঃশব্দ ভয়ের গল্প। আগামীকাল জি৫-এ মুক্তি পাচ্ছে ‘সালি মহব্বত’।
আরও পড়ুন