প্রতিবন্ধী নাইছের ১৮ বছর ধরে বাবার কোলে চড়ে উচ্চতর শিক্ষা জয়ের চেষ্টা

রফিকুল আলম, ধুনট (বগুড়া): দুটো পা আছে, তবে সেগুলোয় বল পায় না মেয়েটি। ডান হাতেও নেই শক্তি। সম্বল তার বাঁ হাত। এ নিয়ে অনার্স শ্রেণি পর্যন্ত চলেছে নিরন্তর লড়াই। সব সময় বাবার কোলে চড়েই ওকে স্কুল-কলেজে যেতে হয়েছে। এবার অনার্স পরীক্ষার পালা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে হার না-মানা মেয়েটি বাবার কোলে চড়ে এসেছে পরীক্ষা কেন্দ্রে। প্রতিবন্ধী এই শিক্ষার্থীর নাম নাইছ খাতুন ওরফে হাসি (২৪)।
বগুড়ার ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে চলতি অনার্স চুড়ান্ত পর্বের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন নাইছ। পরীক্ষা শুরুর দিন থেকেই বাবার কোলে চড়ে যায় বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ কেন্দ্রে। নাইছ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ধুনট উপজেলার বহালগাছা গ্রামে তার বাড়ি। বাবার নাম নজরুল ইসলাম ও মায়ের নাম আকতার জাহান। দরিদ্র এই দম্পতির ঘরে ২০০১ সালে জন্ম নেয় নাইছ খাতুন ওরফে হাসি।
পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বাবা নজরুল ইসলাম তাকে কোলে তুলে নিয়ে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ কেন্দ্রের বিজ্ঞান ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২৫ নম্বর কক্ষের একটি বেঞ্চে বসে দিয়েছেন। পরীক্ষা কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাকেও প্রশ্নপত্র ও খাতা দিয়েছেন। সেখানে বসে সে বাঁ হাত দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই লিখছে খাতায়। নির্ধারিত সময় ৪ ঘণ্টা প্রতিবন্ধী হিসেবে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট পরীক্ষা শেষে আবার একইভাবে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন তার বাবা। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে প্রায় ৩০০ মিটার কাঁচা রাস্তা বাবার কেলো চড়ে পাকা সড়কে যান। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় উঠে বগুড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌছান।
নাইছ ৬ বছর বয়সে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ৫ম শ্রেণীর লেখাপড়া শেষ করে ভর্তি হন বিশ্বহরিগাছা-বহালগাছা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে মানবিক শাখায় এসএসসি পরীক্ষায় ৩.৫৫ পয়েন্ট পেয়ে কৃতকার্য হন। এরপর ২০১৯ সালে বিশ্বহরিগাছা-বহালগাছা বহুমুখী মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ২.৭৫ পয়েন্ট পেয়ে পাশ করেছেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। এবার তিনি ওই কলেজ থেকে অনার্স চুড়ান্ত পর্বের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নাইছ বাড়ি থেকে বাবার কোলে চড়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করছেন।
নাইছের বাবা নজরুল ইসলাম জানান, তার মেয়ে জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবে দূর থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। দুটো পা, একটি হাত নিশ্চল। তাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না। শুধু বসা অবস্থায় বাঁ হাতটি দিয়ে কলম ধরে লিখতে পারে সে। নাইছের মা আকতার জাহান গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাইছ ছোট। বড় ভাই রবিউল করিম একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। জন্ম থেকেই নাইছের ছিল হাসিভরা মুখ। তাই তার মা-বাবা আদর করে নাম রাখেন হাসি। শরীরের এই প্রতিবন্ধিতাকে হাসিমুখেই জয় করেছে মেয়েটি। মনোবল হারায়নি। বাঁ হাতের শক্তি ও মনোবল দিয়ে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে চায় সে। এ কারণে সে মনোবল আর অদম্য আগ্রহ নিয়েই লেখাপাড়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। রাতদিন নিরলস পরিশ্রম করে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নাইছের চিকিৎসার জন্য তার বাবা অনেক ডাক্তার ও কবিরাজের কাছে নিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি।
আরও পড়ুনমা আকতার জাহান বলেন, বাড়ি থেকে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় এবং একাদশ শ্রেণির কলেজের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। তবে অনার্স কলেজ বাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই রাস্তা মেয়েকে কলে তুলে নিয়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হিমশিম খেতে হয় তার বাবার। কিন্ত উপায় নেই। মেয়ে তো আর একা চলতে পারে না। মেয়ের লেখা-পড়ার ইচ্ছা দেখে সব দুঃখ ভুলে যাই।
নাইছ খাতুন বলে, শরীরে শক্তি নেই, তাই কী হবে? মনোবল আর এক হাতের শক্তি নিয়েই জীবন শুরু করেছি। আমি কারও মাথায় বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। বাবার কোলে চড়ে একসময় রাস্তায় বের হলে মানুষ আড় চোখে তাকিয়ে থাকতো। লেখা-পড়া করার কারণে মানুষ এখন ভালোবাসে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের সবার ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে নিজেকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত করতে চাই।
ধুনট সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর একেএম ছোলায়মান হোসেন বলেন, ক্লাস শুরুর আগেই নাইছ খাতুনকে তার বাবা কোলে তুলে শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের সারিতে বসিয়ে রেখে যান। ক্লাস শেষে আবার তাকে কোলে তুলে নিয়ে যান। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ থাকায় তাকে মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবে বলে আমার বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন