যোগাযোগ বাড়াতে গিয়ে কি একা হয়ে পড়ছেন?

লাইফস্টাইল ডেস্ক : সোশ্যাল মিডিয়া ছিল মূলত যোগাযোগের জন্যই। বন্ধু খোঁজা, খবর রাখা, দূরের আত্মীয়ের সঙ্গে সংযোগ রাখা এসব উদ্দেশ্যেই শুরু হয়েছিল অরকুট, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম কিংবা টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই মাধ্যমগুলো বদলে গেছে। এখন এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রেজেন্টেশন, পারফরম্যান্স আর প্রভাব বিস্তার। ব্যবহারকারীরা চর্চা করেন কীভাবে নিজেকে আরও 'ভালো' বা 'আকর্ষণীয়' দেখানো যায়।
এই দৃশ্যমানতার পেছনে একটি অদৃশ্য যন্ত্রণা গেঁথে থাকে। মানুষ যত বেশি নিজেকে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত থাকে, ততই সে নিজের ভেতরের জায়গাগুলোকে অপ্রকাশিত রাখে। ফলস্বরূপ, আমরা কথা বলি কিন্তু শুনি না; চ্যাট করি কিন্তু অনুভব করি না; লাইক দিই, কিন্তু ভালোবাসা জানাই না।
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটানো মানুষদের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং নিঃসঙ্গতার হার অনেক বেশি। ২০১৭ সালে আমেরিকান জার্নাল অফ প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, যারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তারা একাকিত্ব অনুভব করেন অনেক বেশি। আর যে প্রজন্ম স্মার্টফোন হাতে পেয়েই বড় হয়েছে, তারা বাস্তব জীবনের মানবিক যোগাযোগে পিছিয়ে পড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বড় একটা বিপর্যয় তৈরি হয়েছে কথোপকথনে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লম্বা লম্বা বার্তা পাঠাই, কিন্তু চায়ের কাপে বসে দুই মিনিট কথা বলি না। আমরা ইমোজিতে অনুভূতি প্রকাশ করি, কিন্তু চোখে চোখ রেখে কথার ভেতরের সত্যি বুঝি না। জন্মদিনে ফেসবুকে ‘ওয়াল’ ভরে যায়, অথচ একটিবার ফোন করে বলা হয় না, 'ভালো থেকো।' সম্পর্কগুলো ক্রমশ 'ডিজিটাল রুটিনে' বন্দি হয়ে যাচ্ছে।
করোনা মহামারির সময় মানুষ ঘরে থেকেছে, কিন্তু অনলাইনে ছিল আরও বেশি সক্রিয়। ভিডিও কলে অফিস, ভার্চুয়াল মিটিংয়ে ক্লাস, আবার ইন্সটাগ্রামে ‘কুইক রিল’ বানানো সব মিলিয়ে যোগাযোগের নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই ‘নতুন স্বাভাবিক’ আমাদের আরও বেশি ঘরবন্দি করেছে, মনের জানালা বন্ধ করেছে। কাছের মানুষ থেকেও যেন অনেক দূরে চলে গেছে, শুধু যান্ত্রিক সংলাপে লেগে আছে সম্পর্কের ভাঙা সেতু।
এই সংকটের মূলে রয়েছে কথোপকথনের অভাব। প্রযুক্তি আমাদের শোনাচ্ছে, কিন্তু শুনছে না। আমরা বলছি, কিন্তু কেউ শোনে না। এই একমুখী যোগাযোগ সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করছে। একজনের দুঃখ অন্যজন জানতেই পারছে না, কারণ সে তো পোস্ট দেয়নি! আবার অনেকেই অনুভব করেন, কেউ বুঝবে না – এই ধারণা থেকে তারা আর কথাই বলেন না।
একমাত্র পথ হতে পারে সচেতন সংলাপ। প্রযুক্তির ব্যবহারে কোনো দোষ নেই, কিন্তু তা যেন বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প না হয়। ইনস্টাগ্রামে ছবি দেওয়ার পাশাপাশি যেন একদিন ঘুরতে গিয়ে ছবি না তুলে মন খুলে কথা বলা হয়। একঘণ্টা স্ক্রল করার বদলে ১০ মিনিট পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে কাটানো হোক।
আসলে, সম্পর্ক টিকে থাকে কথার সুতোয়। এই সুতো যত টানাটানি হয়, ততই ছিঁড়ে যায়। তাই যতটা সম্ভব, মন খুলে বলা হোক, খোলা মনে শোনা হোক। হয়তো একটা ছোট্ট প্রশ্ন ‘সব ঠিক আছে তো?’ দুই বন্ধুর মাঝে জমে থাকা বরফ গলিয়ে দিতে পারে।
মানুষের যোগাযোগ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের সঙ্গে নয়, পর্দার সঙ্গে। তাই একাকিত্বও বাড়ছে। এই বাস্তবতা বদলাতে হলে আবার ফিরতে হবে মুখোমুখি কথায়। আজ ৩০ জুন, সোশ্যাল মিডিয়া দিবস। এই দিবসে সিদ্ধান্ত নিন যে, আপনি আপনার পরবর্তী প্রজন্মের সামনে কেমন সম্পর্কের উদাহরণ রাখতে চান।
তথ্যসূত্র: আমেরিকান জার্নাল অফ প্রিভেন্টিভ মেডিসিন
মন্তব্য করুন