ডাকসুর ভোটার তালিকা অনলাইনে, নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাড়ছে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি

সাকিব হাসান সজীব : দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে প্রশাসন। তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনী উত্তেজনা বাড়লেও, নারী শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে উন্মুক্ত হওয়ায় বাড়ছে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি।
প্রশাসনের প্রকাশিত তালিকায় শিক্ষার্থীদের নাম, বিভাগ,ছবি, বর্ষসহ তথ্য রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই তালিকা প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু নারী শিক্ষার্থীর ছবি, নাম এবং ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ও অশালীন মন্তব্য করা হচ্ছে। এতে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ওয়েবসাইটে ঢুকে অনেকেই নারী শিক্ষার্থীদের ছবি ও তাঁদের শিক্ষা বর্ষ সংগ্রহ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে তাঁদের নিয়ে হাসাহাসি ও কমেন্ট বক্সে বিভিন্ন অশোভন মন্তব্য করছে অনেকেই।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম ও শামসুন্নাহার হলের সাবেক ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজের শিক্ষাবর্ষ নিয়ে অনেকেই কটূক্তির ঝড় তুলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে অন্যান্য নারী শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কে পড়ছেন তাঁদের ব্যাক্তিগত তথ্য নিয়ে।কেউ কেউ তাঁদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে আবার কেউ কেউ শিক্ষাবর্ষ নিয়ে অশোভন আচরণ ও করছে।
অনেকে বলছেন “আমার নাম তালিকায় দেখে কিছু অপরিচিত ফেসবুক আইডি থেকে ইনবক্স ও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসছে। এরই মধ্যে কয়েকজন অশালীন মন্তব্যও করেছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো পাবলিক ডেটা অনলাইনে প্রকাশ করার আগে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় হয়রানি, প্রতারণা কিংবা অনলাইন স্টকিংয়ের মতো ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফি বলেন,ডাকসুর ভোটার তালিকা ছবিসহ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু অনৈতিকই নয়, বরং নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে।
বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর। অনেকেই পূর্ণ পর্দা পালন করেন, আবার অনেকে ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ভর্তি প্রক্রিয়ায় বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়া ছবি ও তথ্য শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা থেকে নিরাপদে সংরক্ষণ করার কথা ছিল, তা প্রকাশ্যে দিয়ে দেওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি ও অন্যান্য ডেটা ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রাইভেসি রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। যে কোনো ধরনের তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সম্মতি, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। অন্যথায় এটি কেবল প্রাইভেসি লঙ্ঘন নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ক্ষতির পথও তৈরি করে।
আরও পড়ুনছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম বলেন,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অত্যন্ত বিবেচনা বহির্ভূত কাজের এটি একটি। ভোটার তালিকা প্রকাশ্যে আসা ছবিসহ অনেকের প্রাইভেসিই লঙ্ঘন করেছে।আমি ডাকসু করবো কিনা জানিনা। না করার ব্যাপারেই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। অথচ একদল আমার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে হামলে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যে হেনস্থার শিকার আমি হয়েছি, তার দায় নিতে হবে প্রশাসনের।
শামসুন্নাহার হলের সাবেক ভিপি ও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ বলেন,আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া বন্ধু আর আমার বাস্তবতা এক নয়। আজকে যারা নানান ভাবে আমাকে হয়রানি করছে, অসম্মান করছে তাদের এই ক্ষেত্র তৈরি করার পেছনে আমার ত্যাগ, বঞ্চনা আছে৷ এমনকি ছাত্রলীগের থেকে নানান সময়ে নানান রকম সুবিধা নিয়েও মানুষ এখন গলাবাজি করে বেড়ায়, অথচ আমি পুরোটা সময় ছাত্রলীগের সাথে লড়ে গেছি ক্যাম্পাসে।
আমার যে বন্ধুর ভালো ফল করে শিক্ষক হওয়ার ছিল, সে শিক্ষক হয়েছে। আমি আমার নেতৃত্বগুণকে বিকশিত করার চেষ্টা করে গেছি৷ আর এমনও না আমি বছরের পর বছর রিএড নিয়েছি। অনার্সের পরে গ্যাপ নিয়েছিলাম কারণ আমাকে চ্যালেঞ্জ করে মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারে ফেইল করানো হয়েছিল। অনার্সের পরে মাস্টার্সে অনেকেই গ্যাপ দেয়, এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্ত যেভাবে শুধুমাত্র আমার সেশন নিয়ে আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে তা কষ্ট লাগার মতন। আমার নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা থাকলে আমি শুধরে নেব। কিন্ত স্লাটশেমিং কিংবা বয়স নিয়ে শেমিং করা তো আসলে কোনো সুস্থ চর্চা না।
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু বলেন,নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ হোক সবার কাম্য। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকের ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব হয় নাই। প্রশাসন সেটা বিবেচনা করে পুনরায় ভর্তির সুযোগ দিয়েছেন, ভোটার তালিকায় তাদের নাম এসেছে। নিয়ম অনুসারেই তারা যদি ভোটার বা প্রার্থী হতে পারে, আপত্তি করার কোনো ভিত্তি দেখি না। ফেইসবুকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কিছু গ্রুপ সবসময় এধরনের অনলাইন বুলিং, ট্রোলিং উৎসাহিত করে আসছে, প্রশাসন ও প্রার্থীদের উচিত এধরনের প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া।
ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এমনটি তো হওয়ার কথা না। আমাদের ও কিছু করার নেই। ভোটার তালিকা তো প্রকাশ করতেই হবে। তবে অভিযোগ দিলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপাতত কিছুই করতে পারবোনা। তবে আমরা দেখি একটি বিশেষ সেল গঠন করা যায় কি না ভাবছি। আমরা আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রাইভেসি রক্ষা করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। শিক্ষার্থীর সম্মতি, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তথ্য প্রকাশ কেবল প্রাইভেসি লঙ্ঘনই নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ক্ষতির পথও খুলে দিতে পারে।
মন্তব্য করুন