এ,কে, এম মনজুর আলম
পঞ্চাশ বছরের পথচলায় স্মৃতিময় করতোয়া

পঞ্চাশ বছর এটি শুধু সময়ের একটি মাইলফলক নয়, বরং বিশ্বাস, দায়বদ্ধতা এবং অবিচল নিষ্ঠার এক দীপ্ত প্রতিচ্ছবি। দৈনিক করতোয়ার সুবর্ণজয়ন্তী আমাদের মনে করিয়ে দেয় উত্তরবঙ্গের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা এক আস্থাশীল পথচলার কথা, যা শুরু হয়েছিল অনেক প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে। আজ, পঞ্চাশ বছর পর দাঁড়িয়ে আমরা ফিরে দেখি একটি সংবাদপত্র কিভাবে একটি অঞ্চলের আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
১৯৭০-এর দশকের উত্তাল সময়ে, যখন দেশজুড়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর স্বাধীনতার উন্মেষ, তখন উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র বগুড়া থেকে আত্মপ্রকাশ করে দৈনিক করতোয়া। স্বাধীনতাপূর্ব বা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে যখন একটি আঞ্চলিক পত্রিকা প্রকাশ করা ছিল প্রায় দুঃসাহসিক কাজ, তখন করতোয়ার যাত্রা ছিল সত্যিকার অর্থেই এক বিপ্লবী পদক্ষেপ।
এ যাত্রার পেছনে ছিলেন কিছু দূরদর্শী ও সাহসী মানুষ, যারা বিশ্বাস করতেন উত্তরের মানুষের কথা বলতে হলে চাই একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর, একটি দায়বদ্ধ মাধ্যম। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, দক্ষ জনবল সংকট, এমনকি কখনো কখনো রাজনৈতিক চাপ সবকিছু সত্ত্বেও করতোয়া থেমে যায়নি। হাতে লেখা রিপোর্ট, নিজস্ব প্রিন্টিং প্রেসের সংকট, ছাপার কাগজের ঘাটতি এই বাস্তবতার মাঝেও করতোয়ার প্রথম সংস্করণ বের হয়েছিল এক অদম্য আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ নিয়ে। সত্য প্রকাশের দৃঢ় সংকল্পই করতোয়াকে সে সময় এগিয়ে নিয়েছিল।
করতোয়া শুধু সংবাদ পরিবেশনের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সমাজের জন্য একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা পালন করেছে। এই পত্রিকাই বারবার সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছে স্থানীয় দুর্নীতি, অব্যবস্থা, জনদুর্ভোগ এবং কৃষকের দীর্ঘশ্বাস। করতোয়া কথা বলেছে গ্রামের সেই মানুষের হয়ে, যার কণ্ঠ মূলধারার জাতীয় গণমাধ্যমে স্থান পায় না।
করতোয়ার পাতায় উঠে এসেছে নানা ঐতিহাসিক সময়ের দালিলিক চিত্র: ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলো, ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, কিংবা বর্ষায় দুর্যোগপীড়িত জনজীবনের করুণ চিত্র এই পত্রিকা তার লেখনী দিয়ে শুধু ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেনি, অনেক সময় ঘটনাকে প্রভাবিত করেছে।
পঞ্চাশ বছরের এই পথচলায় করতোয়া যেমন পাঠকের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি স্থানীয় সাংবাদিকতা চর্চার একটি মানদন্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অনেক নবীন সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট ও সংস্কৃতিকর্মীর পথচলা শুরু হয়েছে এই পত্রিকার হাত ধরে। এভাবেই করতোয়া হয়ে উঠেছে কেবল সংবাদপত্র নয়, বরং উত্তরবঙ্গের এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। তবে কেবল পেছনের গৌরবগাথা নিয়েই বসে থাকলে চলবে না।
আরও পড়ুনআমাদের সামনে রয়েছে নতুন এক বাস্তবতা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তির বিস্ফোরণ, ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের অগ্রগতি, ভুল তথ্য বা গুজবের বিস্তার, আর পাঠকের পরিবর্তিত রুচি সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সাংবাদিকতা এক নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি। এই নতুন যুগে করতোয়ার প্রয়োজন আরও আধুনিক ও টেকসই রূপে আত্মপ্রকাশ করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা, মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টিং, ডেটা জার্নালিজম, এবং তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
আমরা বিশ্বাস করি, করতোয়া তার পূর্বসূরিদের সততা, সাহস ও দায়বদ্ধতার উত্তরাধিকার বহন করে ভবিষ্যতেও থাকবে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল। আজকের এই সুবর্ণজয়ন্তী হোক একটি নবজাগরণের সূচনা যেখানে অতীতের সাফল্য হবে অনুপ্রেরণা, আর আগামীর চ্যালেঞ্জ হবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
নতুন প্রজন্মের কাছে করতোয়া শুধু একটি সংবাদপত্র নয়, এটি হতে পারে সত্য-সন্ধানী মননের পাঠশালা। করতোয়া যেন তাঁদের শেখায় সাংবাদিকতা মানে কেবল প্রতিবেদন লেখা নয়, বরং সমাজের দর্পণ হয়ে ওঠা; মিথ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যের পাশে থাকা; এবং জনগণের পক্ষে নির্ভয়ে উচ্চারণ করা।
আজ যখন করতোয়া তার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল, তখন আমরা শুধু অভিনন্দন জানাই না আমরা একটি প্রতিজ্ঞা করি। যেন করতোয়া ভবিষ্যতেও থেকে যায় মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি, হয়ে ওঠে আলো, সাহস আর সম্ভাবনার অনন্ত উৎস। শুভ হোক করতোয়ার পথচলা। উজ্জ্বল হোক উত্তরবঙ্গের কণ্ঠস্বর। দীর্ঘজীবী হোক সততার এই বাতিঘর।
লেখক: সভাপতি, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন বাংলাদেশ
বগুড়া অঞ্চল নির্বাহী কমিটি।
মন্তব্য করুন