মো: আরমান সাদিক আবির
উত্তরবঙ্গের কথা বলেছে করতোয়া

পঞ্চাশ বছরের এক গৌরবোজ্জ্বল পথচলার সাক্ষী হলো দৈনিক করতোয়া। এই সুবর্ণজয়ন্তী কেবল একটি পত্রিকার বয়সের হিসাব নয়, এটি একটি আস্থার, নির্ভরতার ও সাহসী উচ্চারণের ইতিহাস যে ইতিহাস গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের মানুষের হৃদয়ে, সংগ্রামে এবং আশায়। বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক করতোয়া জন্মলগ্ন থেকেই নিজেকে শুধু একটি সংবাদপত্র হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং এটি হয়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের মানুষের মুখপাত্র, আর্তনাদের অনুবাদক, স্বপ্নের বাহক এবং ন্যায়ের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
যখন জাতীয় পত্রিকাগুলো রাজধানীকেন্দ্রিক বা বড় শহরকেন্দ্রিক সংবাদে ব্যস্ত থাকে, তখন করতোয়া প্রতিদিন তুলে ধরেছে গ্রামীণ মানুষের অসুবিধা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্যা, এবং সেইসব কণ্ঠ যারা সাধারণত অবহেলিত হয় মূলধারার গণমাধ্যমে। পল্লি চিকিৎসা থেকে শুরু করে নদীভাঙন, বন্যা, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা, স্থানীয় দুর্নীতি, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, কিংবা ছোট শহরের হাসপাতাল সংকট এসব বিষয় করতোয়ার পাতায় গুরুত্ব পেয়েছে, বারবার।
করতোয়া সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে কেবল ঘটনা জানিয়ে থেমে থাকেনি, বরং সমাজকে ভাবতে বাধ্য করেছে। অনেক সময় করতোয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ফলেই প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে, নীতিনির্ধারকরা নজর দিয়েছেন অবহেলিত এলাকাগুলোর দিকে। এই সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাগত সততা করতোয়াকে এনে দিয়েছে মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা।
দৈনিক করতোয়া শুধু সংবাদ প্রকাশ করেনি, বরং একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক জগতেও রেখেছে সক্রিয় ভূমিকা। উত্তরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহিত্য সংগঠন, তরুণ লেখক ও সাংবাদিকদের জন্য করতোয়া একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। নতুন লেখক, কবি কিংবা মতামতদাতারা করতোয়ার কলামেই প্রথম আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন। পত্রিকাটি উৎসাহ দিয়েছে স্থানীয় প্রতিভার বিকাশে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায়, এবং একপ্রকার আত্মপরিচয় গঠনে।
বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় করতোয়ার ভূমিকা ছিল আরও মানবিক ও বাস্তবমুখী। প্রয়োজনীয় ও জরুরি তথ্য পরিবেশন, রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, এবং মানবিক সহযোগিতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে করতোয়া ছিল অগ্রগামী। সে সময়কার সাহসী সাংবাদিকতার মাধ্যমে পত্রিকাটি মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেয়। পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতিদিনই করতোয়া যেভাবে উত্তরবঙ্গের কথা বলেছে, তা কেবল সাংবাদিকতা নয়, এটি একটি দায়বদ্ধ নাগরিকতার প্রকাশ। করতোয়ার পাতায় ফুটে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন, কৃষকের মাটি, শিক্ষার্থীর সংগ্রাম, নারীর অধিকার, এবং নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন।
আরও পড়ুনএই দীর্ঘ পথচলায় করতোয়া যেমন সময়ের সাক্ষ্য বহন করেছে, তেমনি ভবিষ্যতের পথনির্দেশও দিয়েছে। বর্তমানে যখন গণমাধ্যম জটিল সংকটে বাণিজ্যিক চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব ও ভুল তথ্যের ছড়াছড়ির মধ্যে তখনো করতোয়া তার নিজস্বতা বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
সত্য, নিরপেক্ষতা এবং জনস্বার্থে সংবাদ পরিবেশনে অটল থেকে পত্রিকাটি প্রমাণ করেছে যে, আঞ্চলিক পত্রিকাও জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে। আজ করতোয়ার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা শুধু একটি পত্রিকাকে অভিনন্দন জানাই না, আমরা শ্রদ্ধা জানাই এক সংগ্রামী চেতনাকে যে চেতনা সত্য বলার, মানুষের পাশে থাকার, এবং সমাজকে জাগিয়ে তোলার।
আমরা আশাবাদী, আগামী দিনগুলোতে করতোয়া আরও শক্তিশালী, আধুনিক ও প্রগতিশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। নতুন প্রযুক্তি ও পাঠকচাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে করতোয়া হয়ে উঠবে একটি অনন্য আদর্শ গণমাধ্যম যার হৃদয় থাকবে উত্তরবঙ্গের মানুষের সাথে, এবং চোখ থাকবে বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ(আইইউবি)
মন্তব্য করুন