ভিডিও বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫

পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিমান হারানোর স্বীকারোক্তিতে চাপে মোদি সরকার

পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিমান হারানোর স্বীকারোক্তিতে চাপে মোদি সরকার, ছবি: সংগৃহীত।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তান ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল কিনা, এ নিয়ে এতদিন জল্পনা চলছিল ভারতে। আর সেটিরই ইতি টেনেছেন দেশটির সেনা সর্বাধিনায়ক অনিল চৌহান। এতে বিরোধীদের সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।কাশ্মিরের পেহেলগামে হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে এপ্রিলে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। ভারতের অপারেশন ‘সিঁদুরের পর’ পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের সামরিক বাহিনী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

পাকিস্তান জানায়, ভারতীয় বিমান বাহিনীর রাফাল যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছে তারা। এ নিয়ে নয়াদিল্লি এতদিন নীরব থাকলেও মুখ খুলেছেন ভারতের সেনা সর্বাধিনায়ক।গত ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি ঘোষিত হয়। তারপর তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও ভারত সরকার এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও কিছু বলা হয়নি। অবশেষে মুখ খুললেন ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বা সর্বাধিনায়ক অনিল চৌহান।

সিঙ্গাপুরে সাংগ্রিলা ডায়লগে অংশগ্রহণ করার ফাঁকে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। ব্লুমবার্গ টিভির প্রশ্নে চৌহান কার্যত স্বীকার করেন, অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানের আঘাতে ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে।সর্বাধিনায়ককে প্রশ্ন করা হয়, পাকিস্তান কি ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল? এক বা একাধিক? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি চৌহান। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়া বা তার সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেন সেটা ধ্বংস হল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।”

সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তার মানে অন্তত একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের হামলায় ধ্বংস হয়েছিল? এর জবাবে সংক্ষেপে ‘হ্যাঁ’ বলেন চৌহান। তার ভাষায়, “গোটা ঘটনার ইতিবাচক দিক, আমরা কৌশলগত ভুলটা দ্রুত ধরে ফেলেছি। ভুল শুধরে নিয়ে দুদিনের মধ্যে আবার নতুন কৌশল প্রয়োগ করেছি।”

ব্লুমবার্গের সাংবাদিক সরাসরি প্রশ্ন করেন, “পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের হামলায় ভারতের অন্তত ছয়টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। এটা সত্যি?” এই প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের দাবি খারিজ করে দেন চৌহান।

সেনা সর্বাধিনায়কের মন্তব্য সামনে আসার পরে বিরোধীরা নিশানা করেছে মোদি সরকারকে। তারা প্রশ্ন তুলেছে গোপনীয়তা নিয়ে। দেশবাসীকে এই বিষয়ে না জানানোর উদ্দেশ্য নিয়েও সমালোচনা করেছে তারা।দেশের মানুষের আগে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে তা কেন জানানো হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ। তিনি সমাজমাধ্যমে প্রশ্ন করেন, “বিদেশি সংবাদমাধ্যম কেন প্রথমে এই খবর বের করবে? এই তথ্যগুলো কেন প্রথমে ভারতীয়দের, দেশের সংসদকে এবং জনপ্রতিনিধিদের জানানো হয়নি?”

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের বক্তব্য, “সর্বাধিনায়কের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করা উচিত সংসদের বিশেষ অধিবেশনে। কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশকে বিভ্রান্ত করেছে। যুদ্ধ নিয়ে ধোঁয়াশা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।”

কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, “আমাদের পাইলটরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমাদেরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা পাইলটদের সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানাই।”

কংগ্রেসের দাবি, কারগিল যুদ্ধের পরে যেভাবে পর্যালোচনা কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে। তারা যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি তদন্ত করে দেখবে।

এছাড়াও কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের প্রশ্ন রয়েছে যুদ্ধবিরতি ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি হয়েছে কিনা, এ নিয়েও সরকারের জবাব চাইছে তারা। এ বিষয়েও ব্লুমবার্গ টিভি সেনা সর্বাধিনায়ককে প্রশ্ন করলেও সরাসরি জবাব দেননি চৌহান।খাড়গে বলেন, “যুদ্ধবিরতির শর্ত কী ছিল? তাহলে কি কোথাও সমঝোতা হয়েছে? আমাদের কি আপস করতে হয়েছে?”

আরও পড়ুন

শুক্রবার ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি বাণিজ্য বন্ধের কথা বলে দুই দেশকে সংঘর্ষবিরতির পথে নিয়ে এসেছেন। তার বক্তব্য, “আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম, এমন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালাতে পারবো না, যারা পরস্পরের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটছে। এটা বুঝতে পেরে ওরা সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছে।”ট্রাম্পের বক্তব্য, “যুদ্ধ থামাতে সক্ষম হওয়া আমার কাছে গর্বের। ওরা যেটা বুলেট দিয়ে করতে চেয়েছে, আমরা বাণিজ্য দিয়ে করেছি”। তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে সেনা সর্বাধিনায়ক মানতে চাননি।

বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “পারমাণবিক যুদ্ধ ও সাধারণ সংঘর্ষের মধ্যে অনেক তফাৎ। পরমাণু যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। পরমাণু যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি আদতে তৈরি হয়নি।”

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের বিমান বাহিনীর যিনি প্রধান, তিনি বারবার বলেছেন- যে সমস্ত বিমানের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সময় মতো আসেনি।  এরপরই অনিল চৌহানের এই স্বীকারোক্তিতে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের প্রতিরক্ষা কাঠামো যতটা সুরক্ষিত ভাবা হচ্ছিল, ততটা হয়তো সুরক্ষিত নয়। আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে- পাকিস্তানের চীনা বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেম কাজ করেনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে চীনা যুদ্ধবিমান খুবই কার্যকরী। সেগুলো আমাদের যুদ্ধবিমান ভেঙে দিয়েছে। এখনো স্পষ্ট নয় যে কোন বিমান ভেঙে পড়েছে, অত্যাধুনিক রাফাল নাকি প্রাচীন মিগ।”

তবে এই তথ্য প্রকাশ্যে না এনে কি কেন্দ্র ঠিক কাজ করেছে? সমর-সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “যতদিন অপারেশন সিঁদুর চলছিল, ততদিন এটা নিয়ে সেনাবাহিনীর তরফে বিবৃতি দেওয়া কোনো উচিত কাজ নয় বলেই মনে হয়। যতদিন অপারেশন চলে বা সেনাবাহিনী এ ধরনের কাজ করে, ততদিন তারা এসব বিষয় নিয়ে জানায় না। ফলে অনিল চৌহান যে দেরিতে মুখ খুলেছেন, এটা অস্বাভাবিক নয়।”রাজাগোপালের বক্তব্য, “যুদ্ধ যেহেতু শেষ হয়নি, তাই সরকারের কাছে আমরা এ ব্যাপারে বিশদ তথ্য দাবি করতে পারি না। জাতীয় সুরক্ষা বা সেনাবাহিনীর নৈতিক বলের কথা ভেবে সরকার এসব তথ্য নাও দিয়ে থাকতে পারে।”

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলেন, “যুদ্ধের সময় এসব বলা যায় না, সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে। জনগণের মধ্যেও একটা অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে এটা ভেবে যে, আমাদের যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হলো, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করছে না। এখন সংঘর্ষবিরতি হয়ে গিয়ে, তারপরে বিষয়টি বলা হয়েছে।”

রাজাগোপাল বলেন, “সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কর্তার বক্তব্যের পার্থক্য আছে। বিমান কেন ধ্বংস হয়েছে, সরকার সেটা সময় মতো মানুষকে জানাবে। ভারত সরকারের উচিত, দেশের মানুষকে এ সব বলা অথবা কাউকে না বলা। দেশের মানুষ ভাবতেই পারেন যে, বিদেশি সংবাদমাধ্যম সরকারের কাছে যতটা আপন, ততটা দেশের মানুষ নন। এ ধরনের চিন্তাধারা মানুষকে অনেক সময়ে বিভ্রান্ত করতে পারে। বিরোধীরা সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন এটাকে ব্যবহার করার।”

পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সেনা সর্বাধিনায়কের মন্তব্য নির্বাচনী রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

রাজাগোপাল বলেন, “২০১৯ সালে বালাকোট অভিযান করেই বিজেপি জিতেছিল। রাজনীতিতে সরকারের বীরত্বের একটা ভূমিকা আছে। মানুষ খেতে পাক বা না পাক, চাকরি পাক বা না পাক, দেশ অনেকটা এগিয়েছে, এটা মানুষকে গর্বিত করে। যারা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভোটের সুফল পায়, তাদের ক্ষেত্রে মানুষের এই চিন্তাভাবনা অনেক ভোট এনে দেয়। এবার যদি দেখা যায় এটা অনেকটাই ফাঁপা চিন্তাভাবনা, তাহলে ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়বে।”

সুমন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “বিরোধীদের এই প্রশ্নের যৌক্তিকতা আছে যে, এত দাম দিয়ে রাফাল কিনে কতটা যুদ্ধে কাজে লাগলো। রাফাল নিয়ে কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন করে আসছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময়ে তাদের বক্তব্য ছিল, রাফাল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। রাফাল কেনাটা খুব উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলে অনিল চৌহানের বক্তব্য রাফাল নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিতে পারে বা কংগ্রেসের প্রশ্নচিহ্নকে আরো সংগঠিত করতে পারে।”

মইদুল বলেন, “উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ক্ষেত্রে পাকিস্তান নিয়ে একটা উদ্বেগের জায়গা আছে। পাকিস্তানের আক্রমণে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাদের সমাজ হিন্দু–মুসলমানে অনেকটাই বিভাজিত। পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতে হওয়ায় যুদ্ধের জিগির এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিহারের ক্ষেত্রে নীতীশ কুমার ফ্যাক্টর। সেখানে বিজেপি তার জোটসঙ্গী। পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত ও অনিল চৌহানের স্বীকারোক্তির ফলে নীতীশের নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট বিধানসভা নির্বাচনে কতটা সুফল পাবে, সেটা বলা মুশকিল।”

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বগুড়ায় শিমুল হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা ডাবলুসহ দুইজনের রিমান্ড মঞ্জুর 

বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বৃদ্ধি তীর সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন

বগুড়ার দুই ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ, হজে যেতে পারেননি ১১ জন

নাটোরের লালপুরে পদ্মা নদীতে নিখোঁজ জেলের মরদেহ উদ্ধার

বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে ইয়াবাসহ পাঁচজন গ্রেফতার

জেলা প্রশাসনের তৎপরতায় শৃঙ্খলা ফিরেছে নওগাঁর পশুর হাটগুলোতে